আনলাকি থার্টিন। এই শব্দটির সঙ্গে সকলেই কম-বেশি পরিচিত। আধুনিক বিশ্বে বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যাপক উন্নতি হলেও আজও বেশিরভাগ মানুষের মনের মধ্যে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার গেঁথে আছে।শুধুমাত্র আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বের সমস্ত দেশে কম-বেশি সর্বত্রই এই কুসংস্কারের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এই অন্ধ বিশ্বাসের কিংবা কুসংস্কারের নানা রকমভেদ আছে। তারই একটি হল সংখ্যা ঘিরে কুসংস্কার। মূলত সারা বিশ্ব দুটো সংখ্যা নিয়ে বেশি আতঙ্কিত; একটি হল – ১৩ বা unlucky 13 ও অন্যটি হলো 666 বা শয়তানের সংখ্যা। আনলাকি 13 সংখ্যাটি নিয়ে মানুষের মধ্যে কৌতুহল সবচেয়ে বেশি, কৌতূহল নিবারণের জন্য নানা মাধ্যমে বিশেষ করে ইন্টারনেটের সাহায্য নিয়ে অনেক কিছুই জানতে পারা যায়। এই ১৩ সংখ্যাটি ঘিরে যে আতঙ্ক তাকে বলা হয় Triskaidekaphobia। গ্রিক শব্দ “triskaideka” কথার অর্থ ১৩ এবং “phobos” হলো ভীতি। দেখা যায় বিশ্বের নামি দামি বহুতল রেস্তোরাঁ, হোটেল,আবাসন প্রভৃতিতে এই ১৩ সংখ্যাটি ব্যবহৃত হয় না বা এড়িয়ে চলা হয়। এমনকি ১৯৭৭-২০১৩ অব্দি ফর্মুলা ওয়ান খেলায় ১৩ সংখ্যাটি ব্যবহৃত হত না এই অশুভতার কারণে।
এইসব আতঙ্কের পিছনে কাকতালীয়ভাবে মিলে যাওয়া কিছু ঘটনাপঞ্জিকে মনে করা হয়। যদিও তাদের কোন যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। এমন কিছু উদাহরণ তুলে দেবার চেষ্টা করছি :
আপনাদের সেই বিখ্যাত ছবি সকলেরই জানা, বাইবেলে বর্ণিত “”, যেখানেThe last supper দেখা যায় খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তক যীশুখ্রীষ্ট ও তার ১২ জন সহযোগীদের নিয়ে একটি নৈশভোজে আহার গ্রহণ করছেন। বলা হয় সেই নৈশভোজে যীশুর বিশ্বাসঘাতক জুডাস ১৩ তম টেবিলে বসে ছিল। অন্যদিকে ১৩০৭এর ১৩ই অক্টোবর ফ্রান্সের রাজা ফিলিপ iv নাইটস টেম্পলার দের গ্রেপ্তার করে তাদের ওপর প্রচুর নির্যাতন চালায় এবং এদের মেরে ফেলেন। এই নাইটস টেম্পলার ১০৯৬ প্রথম ক্রুসেড এরপর সৃষ্টি হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল জেরুজালেমে আগত বিপুল সংখ্যক ইউরোপীয় তীর্থযাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় ব্যবিলিয়নদের কিছু ‘কোড অফ ল’ থাকত। এমনই একটি হল ‘হামুরাবি কোড’। এই নিয়ম তালিকায় ১৩ নম্বর নিয়মটি তুলে ফেলা হয়। যদিও মূলে কোন নাম্বারিং ছিল না। পরবর্তীকালে এল ডব্লিউ কিং এটি অনুবাদ করেন এবং রিচার্ড হুকার সম্পাদনা করেন, যেখানে এটি তুলে ফেলা হয়। আরো একটি বিষয় বেশ কিছু প্রাচীন সভ্যতায় ১৩ সংখ্যাটিকে ফেমিনিটির সাথে তুলনা করা হয় কারণ সুস্থ স্ত্রীর মানবদেহে আঠাশ দিন অন্তর অন্তর ঋতুচক্র সম্পন্ন হয়, যা একটি বছরে ১৩ বার ঘটে সেই হিসাবে অভিশপ্ত হিসেবে ধরা হয়। এ কথা স্বীকার করতে আপত্তি নেই, আজও এই ঋতুচক্রের মতো স্বাভাবিক ঘটনাকে আমরা সব মানুষ জৈবিক প্রবৃত্তি হিসেবে মানতে পারিনা। এখনও আমরা এটিকে ঘিরে নানা অশুচি বা নিষিদ্ধ কোন বিষয় হিসেবে দেখে চলি।
সব দেশেই ১৩ সংখ্যাটি আনলাকি এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। ইতালিতে ১৩ সংখ্যাটি শুভ হিসেবে ধরা হয়। এই সংখ্যাটি লাকি না আনলাকি এই নিয়ে চিন্তা না করাই শ্রেয়। কারণ বিজ্ঞান মানসিকতায় ভাগ্য নামক অবাস্তব বস্তুটির কোন অস্তিত্ব নেই। তারচেয়ে বরং গণিতে এই সংখ্যার যে বিপুল পরিমাণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়, যা গণিতপ্রেমী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষকে আকর্ষিত করবে। চলুন খাতা পেন নিয়ে শুরু করা যাক।
- ১৩ এমন একটি সংখ্যা যা নিজে মৌলিক এবং একে উল্টো করে লিখলে যা পাওয়া যায়(৩১) সেটিও মৌলিক। এই ধরনের সংখ্যাকে বলা হয় emrip. ১৩ হল emrip এর ক্ষুদ্রতম সংখ্যা। এর অপর একটি উদাহরণ হলো ৩৭।
আবার আমরা সকলেই জানি গণিতে বহু আলোচিত বিষয় হলো ‘ফিবোনাচ্চি রাশিমালা‘।বলা হয় প্রকৃতির নানা রহস্য লুকিয়ে আছে এতে। সেই ফিবোনাচ্চি রাশিমালা শুরু হয় o দিয়ে এবং সিরিজের পরবর্তী সংখ্যাগুলো প্রতিটি তার পূর্ববর্তী দুইটি সংখ্যার যোগফল। শ্রেণী হল ১,১,২,৩,৫,৮, ১৩ এভাবে চলবে। লক্ষ করে দেখুন এই শ্রেণীর সপ্তম সংখ্যাটি হল ১৩।
- ১৩ এখনো পর্যন্ত আবিষ্কৃত উইলসন মৌলিক সংখ্যার তিনটির মধ্যে একটি।
- ১৩ সেই ক্ষুদ্রতম সংখ্যা যার চতুর্থ ঘাত কে দুটি ক্রমিক সংখ্যার(১১৯ও ১২০) বর্গের আকারে লেখা যায়।
আবার পিথাগোরাসের ত্রয়ী সংখ্যার মধ্যে একটি হল ১৩। গণিতে ‘হ্যাপি নম্বর‘ বলে একটি বিষয় আছে। ‘হ্যাপি নম্বর‘ হল যদি কোন সংখ্যাকে তাদের অঙ্কদ্বয়ের বর্গের যোগফলকে একটি সংখ্যায় রূপান্তর করে নতুন সংখ্যা তৈরি করার চেষ্টা করে একটি শ্রেণি তৈরি করার চেষ্টা করা হয় তাহলে দুটি ঘটনা ঘটতে পারে, হয় সংখ্যাটি শেষ অব্দি ১ এ রূপান্তরিত হবে অথবা চলতে থাকবে। যারা ১এ রূপান্তরিত হবে তাদেরকে বলা হয় হ্যাপি নম্বর। ১৩ হল এমনই একটি হ্যাপি নম্বর। প্রথম দশটি হ্যাপি নম্বর হল ১, ৭, ১০, ১৩, ১৯, ২৩, ২৮, ৩১, ৩২, ৪৪।
গণিতে কিছু সংখ্যা আছে যাদের লাকি নম্বর বা শুভ সংখ্যা বলা হয় ।সেই সমস্ত সংখ্যা হল প্রাকৃতিক সংখ্যাসমূহ থেকে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে বাছাই করা সংখ্যার সেট বা ওই সেটের অন্তর্গত প্রত্যেক সংখ্যা। এই বাছাই পদ্ধতি বেশ মজার। প্রথমে ১ থেকে শুরু করে স্বাভাবিক সংখ্যার তালিকা খাতায় লিখে ফেলুন। লক্ষ্য করুন এই তালিকার দ্বিতীয় সংখ্যা হল ২, এবার এই তালিকায় দুই ঘর অন্তর অন্তর সংখ্যাগুলিকে বাদ দিন দেখুন নতুন একটি তালিকা পাবেন যেটি হল ১, ৩, ৫,৭, ৯, ১১…..। নতুন তালিকায় দ্বিতীয় সংখ্যা হল ৩, এই নতুন তালিকায় তিন ঘর অন্তর অন্তর সংখ্যাগুলো বাদ দিয়ে আবার একটি নতুন তালিকা তৈরি করুন দেখবেন সেই তালিকাটি হলো ১, ৩, ৭….। যে নতুন তালিকায় টিকে থাকা শেষ সংখ্যা হল ৭। ঠিক পূর্বের মত সাত ঘর অন্তর অন্তর বাদ দিয়ে আবার একটি নতুন তালিকা পাবেন এভাবে এগিয়ে গেলে,( পর্যায়ক্রমে ‘ক’তম সংখ্যাটি বাদ দিতে হবে; যেখানে ‘ক’ হলো পূর্ববর্তী তালিকায় টিকে থাকা শেষ সংখ্যা), একটি পূর্ণ সংখ্যার তালিকা পড়ে থাকবে যাকে গণিতের লাকি নম্বর বলা হয়। গণিতে ১৩ হল এমনই একটি লাকি নম্বর বা শুভ সংখ্যা।
চাইলে আরো কত বৈশিষ্ট্য খুঁজে বার করা যেতে পারে।
ভাবতে থাকলে আপনিও পেতে পারেন নতুন কিছু, বিষয়টি শিক্ষার্থীদেরও ভাবানো যেতে পারে। সবশেষে যে কথাটি বলার, এ কথা মেনে নিতে কারো অসুবিধা থাকার কথা নয় এই দুই সংখ্যা ঘিরে যে কল্পকাহিনি তার মধ্যে কোন বৈজ্ঞানিক সারবত্তা নেই। আছে কিছু কাকতালীয়ভাবে মিলে যাওয়া ঘটনা পঞ্জি। তাই এইসব কল্পকাহিনিতে মন না দিয়ে আসুন না এই দুই সংখ্যার গাণিতিক সৌন্দর্য উপভোগ করি, সেই সাথে শিক্ষার্থীদেরও সংখ্যা নিয়ে ভাবতে উৎসাহিত করি।
