আমাজনের দাবানলের স্মৃতি আমাদের মনে এখনও সজীব। আমরা দেখেছি আগুনের লেলিহান শিখা কীভাবে গ্রাস করেছিল মাইলের পর মাইল বনভূমি। ভষ্মীভূত হয়েছিল পৃথিবীর ফুসফুস। নিরুপায় প্রাণীদের আর্ত কলরব ছড়িয়ে পড়েছিল ব্রাজিলের আকাশ বাতাসে। বহুদূরে থাকা সাও পাওলো কালো ধোঁয়ার চাদরে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। দুমাস কাটতে না কাটতেই আবারও আগুনের গ্রাসে পৃথিবীর আরেকটি দুর্লভ জীববৈচিত্র্য সম্পন্ন অঞ্চল, অস্ট্রেলিয়া।
বর্তমানে খবরের শিরোনামে অস্ট্রেলিয়ার ‘বুশ ফায়ার’। কী এই বুশ ফায়ার? বুশ ফায়ার হল গ্রীষ্মকালীন মাসগুলিতে অস্ট্রেলিয়াতে হওয়া একটি প্রাকৃতিক দাবানলের ঘটনা। শুষ্ক জলবায়ু যুক্ত অঞ্চলে বিস্তীর্ণ তৃণভূমি বর্তমান, গরমে আর্দ্রতার অভাবে এগুলি শুকিয়ে যায় এবং দাবানলের সৃষ্টি করে।
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় ১৮৫১ সালে ব্ল্যাক থার্সডে বুশ ফায়ার, ১৯৬১ র ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া বুশ ফায়ার ছিল ভয়াবহ। প্রভূত প্রাকৃতিক সম্পদের বিনাশ হয়, শয়ে শয়ে বসতবাড়ি ভষ্মীভূত হয় এরফলে। তবে আগে এই দাবানলের ঘটনা এত নিরবিচ্ছিন্ন ছিল না। পরিবেশবিদরা মনে করছেন বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে বর্তমান সময়ে দাবানলের সংখ্যা দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধুমাত্র শেষ ১০ বছরেই বড় ধরনের দাবানলের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৩ টি। বাতাসে এসময়ে যা আর্দ্রতা থাকা উচিত তার তুলনায় ৭% কম আর্দ্রতা রয়েছে। এই কারণে দাবানল দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
৫ই সেপ্টেম্বর নিউ সাউথ ওয়েলস এবং কুইন্সল্যান্ডে বুশ ফায়ারের ঘটনা সামনে আসে, দু মাসের বেশি সময়কাল ধরে তা ধীরে ধীরে বড় আকার ধারণ করে। বর্তমানে প্রায় 1 মিলিয়ন হেক্টর বা দশ হাজার বর্গ কিলোমিটারের বেশি অঞ্চল জুড়ে এই দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে। এই দাবানল বর্তমানে সিডনির দিকে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে। প্রায় ২০০ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত, বিনষ্ট সম্পত্তির পরিমাণ কয়েক মিলিয়ন ছাড়িয়েছে ।
এই ঘটনায় চরম সংকটের সম্মুখীন হয়েছে কোয়ালা। কোয়ালাদের স্বাভাবিক বাসস্থান হল ইউক্যালিপ্টাস গাছ, বিজ্ঞানের ভাষায় এই গাছ হল ‘fire loving’, সহজেই এই গাছ আগুনের গ্রাসে চলে যায়। কোয়ালা এই পরিবেশের সাথেই নিজেকে অভিযোজিত করে আসছে। কিন্তু জলবায়ুর পরিবর্তন ও বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে দাবানলের চরিত্রের পরিবর্তন ঘটেছে। বতমানের দাবানলগুলির আকার ভয়াবহ, সেই জন্য তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে কয়েক গুণ। যার ফলে কোয়ালারা আর পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারছে না। এর মধ্যেই কয়েকশ কোয়ালার আগুনে পুড়ে মৃত্যু হয়েছে। অগণিত সংখ্যায় কোয়ালারা অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন পশু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ।
কোয়ালা চরম বিপদাপন্ন জীবগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এদের শুধুমাত্র অস্ট্রেলিয়ার কয়েকটি জায়গায় দেখা মেলে। তাই বারংবার দাবানলের ঘটনায় বিজ্ঞানীরা এদের লুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এছাড়াও ক্যাঙ্গারু, প্লাটিপাস, বিভিন্ন সরীসৃপ ও উভচর এই বিস্তীর্ণ দাবানলের কবলে পড়ে অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে।
বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া সরকার দ্রুত দাবানল নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চালাচ্ছেন। রিমোট সেন্সসিং পদ্ধতিতে দাবানল কবলিত এলাকা গুলির দ্রুত চিহ্নিতকরণ চলছে। আধুনিক পদ্ধতিতে দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার কাজ চলছে। আগুনের কারণে সিডনি শহরে ৫০ লক্ষ মানুষ জলসঙ্কটের কবলে পড়তে চলেছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বিভিন্ন সংস্থা মিলিতভাবে কাজ করছে। আশা করা যায় উপদ্রুত এলাকাগুলি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে ।
