আগের পর্বে আপনারা জেনেছেন বিষ্ণোই এবং তাঁদের আন্দোলনের কথা, কিন্তু যুগ যত এগিয়েছে মানুষ নিজের স্বাচ্ছন্দের জন্য পরিবেশকে তত নির্বিকারে যথেচ্ছ ব্যবহার করে।
পরিবেশ আন্দোলনের উদ্দেশ্য
এই প্রসঙ্গে গান্ধীজির একটি কথা মনে পড়ে যায় “Nature is enough for our need, but it is not enough for our greed” সত্যি লোভের কাছে আমরা হয়ত পরাজিত হই, কিন্তু কিছু কিছু মানুষ রুখে দাঁড়ান পরিবেশের রক্ষায় এমনি ছিলেন অমৃতা দেবী যাঁর কথা আগের পর্বে জেনেছেন l এই পর্বে আমরা জানব অন্য একজন পরিবেশপ্রেমীর কথা, তিনি – সুন্দরলাল বহুগুনা l
মানুষ উন্নয়ন আর নগরায়নের ফলে ক্রমাগত ধ্বংস করে চলে অরণ্য আর পরিবেশের, এমনই এক ঘটনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান তিনি সত্তরের দশকে যা ইতিহাসে চিপকো আন্দোলন নামে পরিচিত l
● সুন্দরলাল বহুগুনা :
সুন্দরলাল একজন গান্ধীবাদী পরিবেশ আন্দোলনকারী, তাঁর জন্ম হয় ১৯২৭ সালের ৯ই জানুয়ারী উত্তরপ্রদেশের তেহরি অঞ্চলে, তিনি গাড়োয়াল হিমালয় অঞ্চলে পরিবেশ রক্ষার জন্য আজ পর্যন্ত কাজ করে চলেছেন l
সুন্দরলাল বহুগুনাই ছিলেন চিপকো আন্দোলনের প্রাণপুরুষ l
১৯৮১ সালে এবং ২০০৯ সালে তিনি পরিবেশে রক্ষা আন্দোলনে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য ভারতসরকারের তরফ থেকে যথাক্রমে পদ্মশ্রী ও পদ্মবিভূষণ সন্মান পান l
তিনি ও তাঁর স্ত্রী বিমলা বহুগুনা মিলিত ভাবেই চিপকো আন্দোলন করেন, তেহরি বাঁধ কে কেন্দ্রও করেও তিনি আন্দোলন করেন ১৯৮০ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত এবং দু’বার অনশন করেন ; প্রথমবার ৫৫ দিন ব্যাপী এবং ১৯৯৫ সালে দ্বিতীয় বার ৭৪ দিন ব্যাপী দিল্লীতে রাজঘাটে , এবং কিছুদিন জেল খাটেন l
তিনি একাধিক বইও লেখেন তার মধ্যে উল্লেখ্য হল –
“ধারতি কে পুকার“,
“ইন্ডিয়াস এনভায়রনমেন্ট: মিথ এন্ড রিয়ালিটি” ,
“এনভায়রনমেন্টাল ক্রাইসিস এন্ড সাস্টেইনেবলে ডেভেলপমেন্ট” ইত্যাদি l
● চিপকো আন্দোলন :
স্বাধীন ভারতে প্রথম পরিবেশকেন্দ্রিক আন্দোলনের শুরু হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। স্থান উত্তরাখণ্ডের গাড়োয়াল অঞ্চল। সরকারের লোকজন এখানে ১০০ গাছ কাটতে উদ্যোগী হয়। উদ্দেশ্য ছিল কারখানা স্থাপন।
জঙ্গল বাঁচাও আন্দোলন
প্রথম বাধা দিলেন গ্রামেরই দুই যুবক, সুন্দরলাল বহুগুণা ও চণ্ডীপ্রসাদ ভাট।
গাছকে ‘চিপকে’ বা জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, গাছ কাটার আগে আমাদের হত্যা কর। ধীরে ধীরে গোটা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল এই আন্দোলন।
ইতিহাসে এই আন্দোলন ‘চিপকো আন্দোলন’ নামে পরিচিতি লাভ করল। সেই সময়ের প্রেক্ষিতে সমগ্র বিশ্বে এই আন্দোলন ছিল বিশেষ বার্তাবহ। সরকারের উদেশ্য ব্যাহত হল ঠিকই কিন্তু তাঁরা সম্মানিত করলেন বহুগুণা এবং তাঁর বন্ধু চণ্ডীপ্রসাদকে।
চিপকো আন্দোলনেরই দক্ষিণ ভারতীয় সংস্করণ হল ‘অ্যাপ্পিক্কো আন্দোলন’।
এই আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল কর্ণাটকের উত্তরা কানাড়া ও শিমোগা জেলায়। পাণ্ডরাম হেডজির নেতৃত্বে সংগঠিত এই আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য ছিল প্রাচীন জীবনযাত্রার ভিত্তিপ্রস্তরকে ধ্বংস করতে না দেওয়া এবং জঙ্গলকে ব্যবসায়িক কাজে লাগাতে না দেওয়া। সেই সময় এই আন্দোলন বিপুল সাফল্য লাভ করে।
● চিপকো আন্দোলনের প্রেক্ষাপট,কারণ, এবং
ফলাফল :-
চিন-ভারত সীমান্ত(1964-65) সংঘাতের সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে উত্তর প্রদেশ রাজ্যটি বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে হিমালয়ের অঞ্চলে উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল। দেশি বিদেশি অনেক কোম্পানি হিমালয়ের এই মনোরম পরিবেশকে কোম্পানির জন্য ভালো একটা স্থান হিসাবে চিহ্নিত করতে থাকে।
যদিও গ্রামবাসী বসবাসের জন্য বনভূমির প্রতি ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল- খাদ্য ও জ্বালানি জন্য, জল পরিশোধন এবং মাটি স্থিরতা হিসাবে। কোম্পানি গুলি মূলত বনজ ও প্রাকৃতিক সম্পদের সহজলভ্যতা এবং বিপুল পরিমানে লোভের বশবর্তী হয়ে এই অঞ্চলে আসতে শুরু করে l
কিন্তু কোম্পানির জন্য অনেক জায়গার প্রয়োজনের ফলে প্রচুর পরিমানে গাছ কাটা হয় ও পরিবেশের উপর বেশি পরিমানে দুর্যোগ দেখা দিতে শুরু করে যেমন- খরা, বন্যা ইত্যাদি।
চিপকো আন্দোলন কোন রাজ্যে হয়েছিল
এই পরিস্থিতিতে উত্তর প্রদেশ রাজ্যটি বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে হিমালয়ের অঞ্চলে পরিবেশকে রক্ষার জন্য চিপকো আন্দোলন শুরু হয়।
সুন্দরবাল বহুগুণা, একটি সুপরিচিত পরিবেশবাদী যিনি চিপকো আন্দোলন শুরু করেন। তিনি ছিলেন চিপকো আন্দোলন নেতা এবং মহাত্মা গান্ধীর অহিংসা ও সত্যাগ্রহর দর্শনের অনুসারী।
তিনি এবং তার স্ত্রী দুজনে মিলে প্রথম এই পদক্ষেপ নেন ও এই আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে দেন এবং প্রচুর সংখ্যক মানুষের কাছে যান। বনভুমি রক্ষার জন্য একটি সংগঠন গড়ে তুললেন।
চিপকো আন্দোলন কত সালে শুরু হয়
১৯৭০ এর সময় থেকে এই আন্দোলন শুরু হলেও প্রকৃতপক্ষে ১৯৭৩ সাল থেকে এই আন্দোলন চরম আকার নেয়। ও সারা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ১৯৭৪ সালে l
মহিলা ও পুরুষ সব নির্বিশেষে উভয় এই আন্দোলনে যোগ দেয়। ১৯৭০ সালে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এই ধরনের আন্দোলন শুরু করেছিল। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন – সুবেদার দেবী, বাচ্চিনী দেবী, চণ্ডী প্রসাদ ভট্টা, গোবিন্দ সিং রাওয়াত, ধুম সিং নেজি, শমসের সিং বিশ্বাস এবং ঘানসিম রাতারু প্রমুখ যাঁরা আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন l
বনভুমি রক্ষার নেতারা ভারতবর্ষের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে আপিল করেন, এর ফলে ‘হরিজন’ পত্রিকায় গাছ কাটা নিষেধাজ্ঞা করা হয়েছিল।
২৬শে মার্চ প্রতি বছর চিপকো আন্দোলন দিবস হিসাবে পালিত হবে বলে ঠিক করা হয়।
১৯৮০ সালে উত্তরপ্রদেশের বনের ১৫ বছর ধরে গাছ কাটার জন্য নিষিদ্ধ ছিল। এরপর হিমালয় রাজ্য, কর্ণাটক, রাজস্থান, বিহার, পশ্চিমঘাট ও বিহারে নিষিদ্ধ করা হয়।
● সাইলেন্ট ভ্যালি আন্দোলন :
কেরলের পলক্কড়- এ ‘সাইলেন্ট ভ্যালি’ এলাকাটি চিরহরিৎ অঞ্চলে পরিপূর্ণ এবং পশু-পাখি গাছপালা নিয়ে গড়ে ওঠা এক বিরাট জীববৈচিত্রের ধারক ও বাহক। হঠাৎ বিপত্তি ঘটল এক ফরমানে। উদ্দেশ্য জলবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন। ফলে, ব্যাপক বৃক্ষনিধন। ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন ওই অঞ্চলের বাসিন্দারা। শুরু হল অরণ্যরক্ষার জন্য আন্দোলন ১৯৭৮ সালে l
‘সাইলেন্ট ভ্যালি’ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন
পক্ষীবিশারদ সেলিম আলি
সবুজ বিপ্লবের রূপকার এস স্বামীনাথন,
কবি সুগাথা কুমারী,
কেরলের শাস্ত্র সাহিত্য পরিষদ l
এই আন্দোলনের জেরে সরকারের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়। ফলস্বরূপ বর্তমানে বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের মর্যাদা পেয়েছে এই উপত্যকা।
১৯৮৫ সালে সাইলেন্ট ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক গড়ে ওঠে l
● জঙ্গল বাঁচাও আন্দোলন :
১৯৮২ সালে এই আন্দোলন গড়ে ওঠে মূলত বিহারের সিংভূম জেলায় এরপর ক্রমশ ছড়িয়ে পরে ঝাড়খন্ড এবং ওড়িশায় l আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন সিংভূমের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষরা, স্থানীয় বনভূমিতে শাল ও টিক গাছ নির্বিচারে ছেদন করাকে কেন্দ্র করে আন্দোলন শুরু হয় l
পরিবেশ আন্দোলনের নাম | নেতা | কোথায় এই পরিবেশ আন্দোলন হয়েছিল | পরিবেশ আন্দোলনউদ্দেশ্য |
---|---|---|---|
সাইলেন্ট ভ্যালি বাঁচাও আন্দোলন | কেরালা শাস্ত্র সাহিত্য পরিষদ নামক সংস্থা, কবি সুগাথা কুমারী প্রমুখ | পলক্কড়, কেরালা | চিরহরিৎ সাইলেন্ট ভ্যালি অঞ্চল নষ্ট করে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে |
চিপকো আন্দোলন(১৯৭৩) | সুন্দরলাল বহুগুণা, চণ্ডীপ্রসাদ ভাট, সরলা বেন, মীরা বেন | উত্তরাখণ্ডের চামোলি, তেহরি-গাড়ওয়াল জেলা | হিমালয়ের পাদদেশে গাছগুলিকে বাঁচানো |
আপ্পিকো আন্দোলন | পাণ্ডুরাও হেগড়ে | কর্ণাটকের সিরসি অঞ্চলে | বনভূমির গাছ রক্ষা করা |
বিষ্ণোই আন্দোলন (অষ্টাদশ শতক) | অমৃতা দেবী এবং বিশ্নোই সম্প্রদায় | খেজারলি, মাড়োয়ার প্রদেশ, রাজস্থান | গ্রামবাসীরা গাছ কাটার প্রতিবাদে গাছগুলিকে জড়িয়ে ধরে থাকে। |
জঙ্গল বাঁচাও আন্দোলন (১৯৮২) | আদিবাসী সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে | ঝাড়খণ্ডের সিংভূম জেলা | সরকারি উদ্যোগে শাল, টিক গাছের জঙ্গল কাটার প্রতিবাদে। |
বালিয়াপাল আন্দোলন | ওড়িশার বালেস্বর | ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি নির্মাণের প্রতিবাদে। | |
ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি নির্মাণের প্রতিবাদে। | মধ্যপ্রদেশের হোসেঙ্গাবাদ |
>> ১ম পর্ব



Bhalo lekha