


দিল্লির দূষণ ঘড়িতে ফের বিপদ ঘন্টি বাজছে। বায়োলজিক্যাল ক্লক মানে যেটার জন্য সকালবেলা ঠিক সময়ে অ্যালার্ম ছাড়াই অনেকের ঘুম ভেঙ্গে যায়, সেরকমই দিল্লির একটা নিজস্ব দূষণ ঘড়ি আছে। ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর ব্যাপারটা আন্ডার কন্ট্রোল থাকলেও গোলাতে শুরু করে নভেম্বর থেকে। চলে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। দূষণ রকেট গতিতে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে। ধরুন দূষণ এতটাই যে তখন দিল্লির বাতাসে শ্বাস নিলে আপনি না চাইলেও দিনে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশটি সিগারেটের ধোঁয়া শ্বাসের সাথে গ্রহন করতে বাধ্য। কেন ? কারণ সেই হিজবিজবিজ এফেক্ট। সিগারেটের বদলে দিল্লিতে বসে মটকা কুলফি খেলেও ঠিক ততটাই দূষণের শিকার আপনি। কারণ এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে অক্টোবরে দিল্লীর মাত্রা থাকে ৩০১ – ৪০০, যেটা ভেরি পুওর। নভেম্বরে সেটাই হয় ৪০১-৫০০, যেটা সিভিয়ার। আর ডিসেম্বরে সেটা ছোঁয় ৫০০+, মানে হ্যাজার্ডস্। ২০১৭র নভেম্বরে এটার মাত্রা ছুঁয়েছিল ৯৯৯, যাকে বলা হয় ‘গ্রেট স্মগ অব্ ডেলহী’। মজার কথা মাত্রাটা আরো বেশি হতে পারত, কিন্তু এয়ার কোয়ালিটি মনিটর করার মেশিনগুলোয় এর থেকে বেশি দূষণ মাপার ব্যবস্থা নেই। এক্কেবারে হিজবিজবিজ এফেক্ট বলুন !
এয়ার কোয়ালিটি মনিটর করা হয় মূলত দুটি কণার কথা মাথায় রেখে। পি.এম ২.৫ ও পি.এম ১০। পারটিক্যুলেট ম্যাটার ১০ এর আয়তন ১০ মাইক্রন বা তার কম এবং পি.এম ২.৫ এর আয়তন ২.৫ মাইক্রন বা তার কম, ধরুন মানুষের চুলের ২৫ থেকে ১০০ গুণ সূক্ষ এই কণাগুলি। ২০০৮ থেকে ২০১৩র মধ্যে ৯১টি দেশের ১৬০০টি শহরে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে বিশ্বে গড়ে প্রতি কিউবিক মিটার বাতাসে পি.এম ১০ থাকার কথা ২৮৬ মাইক্রোগ্রাম। কিন্তু ২০১০এ দিল্লিতে এর মাত্রা ছিল ২৮৬ মাইক্রোগ্রাম প্রতি কিউবিক মিটার বাতাসে। ২০১৩তে পি.এম ২.৫ এর মাত্রা পৌঁছে গিয়েছিল ১৫৩ মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘন মিটার বাতাসে। গোয়ালিয়র, মানে দেশের মধ্যে যে শহরের বাতাস সবচেয়ে দূষিত, সেখানে পি.এম ১০ ছিল ৩২৯ মাইক্রোগ্রাম আর পি.এম ২.৫ ছিল ১৪৪ মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘনমিটার। লন্ডনের সঙ্গে তুলনা করলে আঁতকে উঠবেন, পি.এম ১০ সেখানে ২২ মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘনমিটার, আর পি. এম ২.৫ ১৬ মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘনমিটার।
এরকম ব্যাপক দূষণের কিন্তু অনেকগুলো কারণ রয়েছে। দিল্লির জনসংখ্যার চাপ, রাস্তায় গাড়ির সারি দুটোই শিরে সংক্রান্তির কাজ করছে। ‘মিনিস্ট্রি অব্ আর্থ সায়েন্স’ ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে যে সমীক্ষা চালিয়েছেন, তাতে দেখা গেছে দিল্লির দূষণের ৪১% হয় গাড়ির ধোঁয়ার কারণে। ২১.৫% হয় ডাস্ট বা ধুলো থেকে আর ১৮% হয় শিল্পাঞ্চলের দূষিত ধোঁয়ার জন্য।
২০১৮ সালের অক্টোবরের আগে পর্যন্ত বদরপুর পাওয়ার প্ল্যান্ট দূষণের আগুনে রীতিমতো ঘি ঢালছিল। পুরোপুরি কয়লার ওপর নির্ভরশীল এই পাওয়ার প্ল্যান্ট দিল্লীর প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের ৮% যোগাতো, কিন্তু এখান থেকেই আসত ৮০-৯০% পি.এম। এখন অবশ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারি নির্দেশে বন্ধ আছে বদরপুর পাওয়ার প্ল্যান্ট।
লেখার শুরুতেই যেটা বলেছিলাম, শীতকাল এগিয়ে আসলেই দূষণের ঘনঘটাটা এখানে কয়েকগুণ বেড়ে যায়, এর আরেকটা কারণ কিন্তু স্টেবল বার্নিং। মানে দিল্লির আশপাশের গ্রামগুলিতে এইসময় ফসলের অবশিষ্টাংশ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এর সাথে জ্বলে কয়লার উনুন, ওড়ে ঘুঁটের ধোঁয়া। শীতকালের ধীর ও ভারী বাতাসে এই সমস্ত ধোঁয়া ধুলো স্মগ বা ধোঁয়াশা হয়ে আটকা পড়ে যায় দিল্লির আকাশে।
দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীওয়াল ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন, দিল্লি আপাতত গ্যাস চেম্বারে রূপান্তরিত হয়েছে। প্রাক্তন ক্রিকেটার অজয় জাদেজার বাড়িও দিল্লীতেই। গত ২রা নভেম্বর দিল্লির দূষণমাত্রা আবার ৯০০ ছুঁয়েছে। জাদেজা বাধ্য হয়ে দিল্লি ছেড়ে কিছুদিনের জন্য গোয়া চলে গেছেন। যাবার আগে রয়টার্সকে জানিয়ে গেছেন, “নিশ্বাসই যখন নিতে পারছিনা, তখন কিছুদিনের জন্য পালিয়ে যাওয়াই ভালো।” দিল্লিতেই থাকেন জিন্দাল গোষ্ঠীর অভিমন্যু জিন্দাল। তাঁর বাড়িতেও দূষণ মোকাবিলার জন্য রয়েছে প্রায় ৪০০ টা এয়ার পিউরিফাইং প্ল্যান্টস, সাথে দুডজন এয়ার পিউরিফায়ার যন্ত্র। কিন্তু এতটা সাবধানতা নেওয়া যাদের পক্ষে সম্ভব নয়, তারা মুখে রুমাল আর মাস্ক বেঁধে যোঝার চেষ্টা করছেন। আর যুঝছে দিল্লির ২.২ মিলিয়ন শিশুছানারা, ভেঙ্গে পড়া ফুসফুস আর ইমিউনো সিস্টেম নিয়ে যদি আগামিটা একটু ভালো হয় এই আশায়।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স, উইকিসংকলন, ইন্ডিয়াটুডে.ইন, এন.ডি.টি.ভি.কম, নিউজ.এইট্টিন.কম