এক্কেবারে ডোডো হয়ে যাবার আগে ভারতীয় জিপস্ শকুনরা ভাগাড় থেকে খবরের কাগজে একটুখানি জায়গা পেয়েছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় সম্প্রতি লোকসভায় লিখিত জানিয়েছেন, শকুনদের সংখ্যা গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। রাশিয়া আমেরিকার সঙ্গে বন্ধুত্ব হলেও দেশের তস্য নগণ্য আত্মীয়রা সময়ের উল্টোদিকে চলে যাচ্ছে, যেখান থেকে ফসিল ছাড়া আর কিছু ফেরত পাওয়া যায় না।
২০১৮ সালের জুন মাসে গুজরাটের সব কটি জেলা জুড়ে গুজরাটের রাজ্য বনদপ্তরের সঙ্গে যৌথভাবে গুজরাট ইকোলজিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ ফাউন্ডেশনের চালানো ছানবিনে জানা গেছে, ২০০৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ৭৫.৮ % হারে শকুনের সংখ্যা কমে গেছে। আহমেদাবাদ অঞ্চল আরো এক কাঠি চিন্তাসঙ্কুল, এখানে শকুনের সংখ্যা কমার হার ৮০%। ২০০৫এ ২৫৪টি শকুন যেখানে বিচরণ করত, ২০১৮তে তাদের সংখ্যা নামতে নামতে এসে দাঁড়িয়েছে সাকুল্যে পঞ্চাশটিতে। আই আই এম আহমেদাবাদ পড়াশোনার জায়গা হিসাবে নামকরা, কিন্তু পক্ষীপ্রেমিকরা সবাই ম্যানেজমেন্টের লোক না হলেও আই আই এমের ক্যাম্পাসটিকে চিনতেন গুজরাটের সবথেকে বেশি সংখ্যক শকুন কলোনির বাসস্থান হিসাবে। গত কয়েক বছরে ক্যাম্পাসের আধুনিকীকরণের ফলে শকুনরা এখন আর এখানে আসে না। আরেকটা হিসাব থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১৬ সালে গুজরাটে ৯৯৯টা শকুন বেঁচে ছিল, ২০১৮তে তারা আছে ৮২০ জন। সংখ্যা কমার হার ১৮%। শকুনের সংখ্যা কমার চিন্তাটা একা গুজরাটের নয়, গোটা দেশে ঝর্ণার মতো সংখ্যাটা প্রবলভাবে নিম্নগামী। ১৯৭০ এর দশকে যেখানে সংখ্যাটা ছিল ৪০ মিলিয়ন, ২০১৫ তে সেরা ১৯,০০০। ৪০ মিলিয়ন সংখ্যায় লিখতে ৪০ এর পর আরো ছয়খানা শূন্য বসাতে হয়। মানে সারা দেশে শকুন কমেছে ৯৯.৯৫% হারে। যে কয়েকজন টিকে আছে এখনও, তাদের গলায় একটা ক্রিটিক্যালি এনডেনজারড্ তকমা আঁটা রয়েছে।
ভারতে প্রায় নয় প্রজাতির শকুন পাওয়া যায়। এদের মধ্যে সঙ্কটাপন্ন হয়ে হারিয়ে যেতে বসেছে চারটি প্রজাতি। জিপস্ ভালচার, হোয়াইট ব্যাকড্ ভালচার, লঙ্গ বিলড্ ভালচার ও স্লেন্ডার বিলড্ ভালচার এই তালিকায় জায়গা পেয়েছে।
২০১৫ সালে বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি ও আর এস পি বি-র উদ্যোগে ভারতের ১৩খানা রাজ্য আতিপাতি খুঁজে, ১৫,৫০০কিমি রাস্তা পেরিয়ে সাম্প্রতিককালের মধ্যে শেষবারের মতো দেশব্যাপী শকুনদের সংখ্যা গোনা হয়েছিল। ২০১৭ সালে তার রিপোর্ট প্রকাশিত হয় এবং দেখা যায় দেশে হোয়াইট ব্যাকড্ ভালচারের সংখ্যা ৬০০০, লঙ্গ বিলড্ ভালচার আছে ১২০০০ ও স্লেন্ডার বিলড্ ভালচার ১০০০। ১৯৭০- ৮০ -এর দশকের সঙ্গে তুলনা করলে যে পরিসংখ্যানগুলো একটাও স্বস্তি দেয় না। এছাড়াও ভারতে হিমালয়ান ভালচার ও ইউরেশিয়ান গ্রিফনেরও দেখা মেলে। কিন্তু হিমালয়ান ভালচাররা পার্বত্য অঞ্চলের বাসিন্দা, আর ইউরেশিয়ান গ্রিফনরা এদেশে আসে শীত কাটাতে। তাই শকুন হলেও এদের কথা আলাদা।
শকুনদের সংখ্যা যে কমছে সেটা নব্বইয়ের দশক থেকেই চোখে পড়েছিল। তবে কারণটা অস্পষ্ট ছিল। পরে বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেতে দেখলেন, মরণাপন্ন গবাদি পশুদের প্রদাহ, ব্যথা ও জ্বর কমানোর জন্য ভারতে প্রায়ই ডায়াক্লোফেনাক নামক একটি ওষুধ ব্যবহার করা হয়। ডায়াক্লোফেনাক এই মৃতপ্রায় পশুদের মাংসপেশীর সঙ্গে মিশে যায় এবং মারা যাবার পরও শরীর ডায়াক্লোফেনাকের প্রভাব বহন করতে থাকে। শকুনরা মৃত পশুপাখির দেহাবশেষ খেয়ে বেঁচে থাকে এবং মাংসের সাথে ডায়াক্লোফেনাকও তাদের শরীরে প্রবেশ করে। শকুনের রেচনতন্ত্রের পক্ষে ডায়াক্লোফেনাক বিষের মতো। শকুনদের কিডনি স্টোন তৈরি হতে থাকে এবং নি:সাড়ে সংখ্যা কমতে থাকে। একটা হিসাব বলছে, ১% ডায়াক্লোফেনাক যুক্ত পশু মৃতদেহের ফলে শকুনের সংখ্যা ৬০ থেকে ৯০% হারে কমে যেতে পারে, কিন্তু আসলে প্রায় ১০% মৃত গবাদি পশুর দেহেই ডায়াক্লোফেনাক খুঁজে পাওয়া যায়।
ডায়াক্লোফেনাকের মারণ প্রভাবে শকুনদের ঝাড়ে বংশে নির্মূল হয়ে যাওয়া আটকাতে ২০০৬ সালের ড্রাগস্ ও কসমেটিকস্ অ্যাক্ট অনুযায়ী ভারতে ডায়াক্লোফেনাকের উৎপাদন, বিক্রি ও সরবরাহ নিষিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু মুনাফা বড় লোভনীয়। ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলি খেয়াল করে, পশুদের জন্য হলেও মানুষের জন্য ডায়াক্লোফেনাক নিষিদ্ধ হয়নি। ওষুধ তৈরি অব্যাহত থাকে ও চোরাপথে পশুদের ওপর প্রয়োগ করাও চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ২০১৫ সালে ডায়াক্লোফেনাক সর্বৈবভাবে নিষিদ্ধ হয়। বাজারে মেলোক্সিক্যাম নামে নতুন বিকল্প ওষুধ আসে, যা শকুনদের জন্য নিরাপদ। কিন্তু ডায়াক্লোফেনাক ঘরানারই অনেক ওষুধ, যেমন কিটোপ্রোফেন, নিমেসুলাইড বাজারে চাইলেই মেলে। এগুলির সবকটি শকুনদের জন্য ক্ষতিকারক।
যে মাত্রায় শকুন অবলুপ্ত হয়ে গেছে, তাতে পরিবেশের যে একান্ত নিজস্ব একটা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ছিল, সেটা ভেঙে গেছে। মৃত গবাদি পশুরা যে রেবিস্, অ্যানথ্রাক্স ইত্যাদি প্যাথোজেন বহন করত, তার সবটাই শকুনের পরিপাকতন্ত্রে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। কিন্তু শকুন কমে যাবার ফলে ইঁদুর, কুকুরের সংখ্যা অনেকটা বেড়ে গেছে, যারা গবাদি পশুদের মৃতদেহ খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে। বিভিন্ন রোগজীবাণু স্বাভাবিকভাবেই মৃত প্রাণীদের দেহ থেকে ইঁদুর, কুকুরদের মতো ক্যারিয়াররা বহন করে ভাগাড়ের বাইরে নিয়ে আসছে।
ভারতের অনেকগুলো জায়গায় শকুনের ক্যাপটিভ ব্রিডিঙ করানো হয়ে থাকে।
পশ্চিমবঙ্গের রাজাভাতখাওয়াতে এরকম কেন্দ্র আছে। আশার কথা তাদের উদ্যোগে সাফল্যও পাওয়া গেছে।
তথ্যসূত্র : দ্য হিন্দু, বার্ড লাইফ, ওয়াক থ্রু ইন্ডিয়া, উইকিপিডিয়া
লেখক – শুভজিত কর চৌধুরী