আমরা নিজেদের ফাঁদে নিজেরাই পড়েছি। মানে আমরা ট্র্যাপে পড়েছি। ট্র্যাপ মানে TRAP অর্থাৎ Traffic Related Air Pollution। যদিও এখানে ট্র্যাফিক সম্পর্কিত দূষণের উপর জোর দেওয়া হয়েছে, তার মানে এই নয় যে অন্যান্য উৎস থেকে আসা ক্ষতিকর বস্তুকণা বা পার্টিকুলেট ম্যাটার (PM) আমরা উপেক্ষা করব। বায়ুতে ভাসমান বস্তুকণা চিরকালই ছিল তবে আজকাল এতো বায়ু দূষণ হচ্ছে কেন? আজকাল বায়ুতে এত ক্ষতিকারক কঠিন বস্তুকণা বা পারটিকুলেট ম্যাটার(PM) আসছে কোথা থেকে? এর একমাত্র কারণ মানুষের কাজকর্ম। যদি দাবানলে জঙ্গল পোড়ে বা আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাত হয় তাহলেও বাতাস ভরে ওঠে বিষাক্ত ধোঁয়ায় আর বস্তুকণায়; কিন্তু এই দুর্যোগ তো সবসময় ঘটে না! অথচ মানুষ তার কাজকর্মের দ্বারা সারা পৃথিবীর বাতাস, সারা বছর ধরে দূষণে ভরিয়ে রেখেছে।
বায়ুতে নানা দূষিত পদার্থ আছে। নাম করে বললে বলতে হয় কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের মত গ্যাস, ওজোন, ভারি ধাতু যেমন সিসা, পলিসাইক্লিক অ্যারোমাটিক হাইড্রোকার্বন(PAHs) ইত্যাদি। এর মধ্যে পার্টিকুলেট ম্যাটার ২.৫ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ক্ষতিকর পদার্থ যা সম্ভবত মানুষের স্বাস্থ্যের পক্ষে সব থেকে বিপদজনক। অতিসূক্ষ্ম কঠিন বস্তুকণা PM ২.৫ আসে মূলত জীবাশ্ম জ্বালানি যেমন কয়লা, পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্য পুড়িয়ে। তাছাড়াও অন্যান্য উৎস আছে যেমন জ্বালানি কাঠের ছাই, ধুলো ইত্যাদি। এদের পার্টিকুলেট ম্যাটার ২.৫ বলা হয় কারণ এই কনাগুলির ব্যাস ২.৫ মাইক্রো মিটারের চেয়ে কম।
প্রতিদিন আমরা শ্বাস নেওয়ার সময় ১০,০০০ লিটার বায়ু গ্রহণ করি। বাতাসের ক্ষতিকর সূক্ষ্মতম বস্তুকণাগুলো এই বায়ুর সাথেই শ্বাসনালী দিয়ে ফুসফুসে পৌছায়। রক্তের অক্সিজেন আর কার্বন ডাই অক্সাইড আদান প্রদানের সময় ব্যাপন প্রক্রিয়ায় রক্তের সাথে মিশে যায়। সম্ভবত রক্তের মাধ্যমে শরীরের অন্যান্য অংশের সাথে মস্তিষ্কেও পৌঁছে যায়। বস্তুকণাগুলি কী করে ব্রেন বা নার্ভ অবধি পৌছায় তার সঠিক পদ্ধতি জানার জন্য গবেষণা চলছে। বিজ্ঞানীদের অনুমান হল বস্তুকণাগুলির টার্গেট সেরিব্রাল হোয়াইট ম্যাটার, করটিকাল গ্রে ম্যাটার আর বেসাল গ্যাংগলিয়া।
গার্ডিয়ান পত্রিকা বলছে বাইপোলার ডিসঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া, পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার, ডিপ্রেশন এই চারটে ডিসঅর্ডার তাদের মধ্যেই বেশি আছে যাদের ছোটবেলা বায়ুদূষণের মধ্যে কেটেছে। ঘন বায়ুদূষণ পূর্ণ এলাকাতে বড় হয়েছে এরকম বাচ্চাদের বুদ্ধির বিকাশ ভালোভাবে হচ্ছে না, সেইসঙ্গে বড় হওয়ার সাথে সাথে ডিপ্রেশন তৈরি হচ্ছে। বাচ্চাদের মধ্যে কম বুদ্ধিমত্তা, মনোযোগের অভাব, কম আই কিউ, দুর্বল স্মৃতিশক্তি দেখা যাচ্ছে যার ফল দেখা যাচ্ছে স্কুলের রেসালটে। গত ১০ বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে যে সব প্রাপ্তবয়স্করা দূষিত পরিবেশে বসবাস করেন তাদের বুদ্ধিমত্তা হ্রাস পেয়েছে ও ডিমেন্সিয়া রোগটি দেখা গেছে। এখনও অনেক কিছুই জানার বাকি আছে যেমন কী করে কণাগুলি ব্রেন পর্যন্ত পৌছায়? বস্তুকনাগুলির প্রভাব ব্রেন ও নার্ভের উপর কতদিন থাকে? তবে এটা জানা গেছে অতিসূক্ষ্ম বস্তুকণার প্রভাবে ব্রেন ইনফ্ল্যামেসন আর স্ট্রেস হরমোন রিলিস হয় যা মানসিক চাপ বাড়ায়।
হু এর রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি ১০ জনে ৯ জন মানুষ দূষিত বায়ু সেবন করতে বাধ্য হচ্ছে। হু এর গাইড লাইন অনুযায়ী বায়ুর বস্তু কণা PM ২.৫ গড়ে বছরে ১০মাইক্রো গ্রাম প্রতি কিউবিক মিটার বায়ুর চেয়ে বেশি হবে না। অথচ দিল্লিতে এর পরিমাণ ১৩৩ মাইক্রো গ্রাম প্রতি মিটার কিউব এবং কলকাতায় ১৫৯ মাইক্রো গ্রাম প্রতি মিটার কিউব। একটি গবেষণা পত্রে ১৬ টি দেশের থেকে তথ্য সংগ্রহ করে, সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে, মানসিক অবসাদ ও আত্মহত্যার সঙ্গে বায়ু দূষণের গভীর এবং দৃঢ় যোগ রয়েছে। বাতাস পরিষ্কার রাখা তাই খুব প্রয়োজন। মস্তিষ্কে জং পড়া একটা মানুষ কী মানুষের মতই ব্যবহার করতে পারবে? এমন ভবিষ্যৎ না চাইলে বায়ু আর ব্রেন দুটোই পরিষ্কার রাখতে হবে।
মৌমিতা হিরা