মেডিকেল আর্থপোডোলজি, পতঙ্গ বহু রোগের জীবাণুর বাহক হিসেবে কাজ করে, এবং সেই রোগের বিস্তারে প্রধান ভূমিকা পালন করে ।মানুষ বহু রোগে, এই সব বাহকের দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং বাহক পতঙ্গরূপে মশার বেশ নামডাক, বিশেষ করে বলতে হলে স্ত্রী মশার কথাই বলতে হয়, কারণ স্ত্রী মশাই রক্ত খায়, পুরুষ মশা নয়! মশা ডিম পাড়ে, সেই ডিম পাড়ার ক্ষেত্রে হিমোগ্লোবিন-এর একটি ভূমিকা আছে, তাই মশার নিজের বংশবিস্তারের জন্যই আমাদের রক্ত চোষা!
মশা বাহিত বহু রোগের মধ্যে এখন আমাদের ত্রাস হল ডেঙ্গু বা ডেঙ্গি, শব্দটি একটি স্প্যানিশ বাগধারার অংশ বিশেষ যার অর্থ হল শয়তানের দ্বারা সৃষ্ট রোগ ।
অর্থপড সৃষ্ট রোগগুলি তৃতীয় বিশ্ব এবং উন্নয়নশীল দেশ যেমন, দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশ গুলি ক্রান্তীয় অঞ্চলের দেশ গুলিতে বেশি পরিমানে দেখা যায়, ডেঙ্গু যদিও বহু প্রাচীন একটি রোগ যা, 350-400AD তে এবং 1700 শতকে দেখা
গিয়েছিল।
পশ্চিম বাংলায় বিগত 5-7 বছরে, এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে, 2019এ আক্রান্তের সংখ্যা কয়েকহাজার ছাড়িয়েছে, মৃত্যুর সংখ্যা দুই অংকের ঘরে ইতিমধ্যেই পৌঁছেছে ।সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, উত্তর 24 পরগণা জেলা ।
ডেঙ্গু একটি RNA ভাইরাস ঘটিত এবং মশা বাহিত রোগ, মূলত ক্রান্তীয় অঞ্চলে উন্নয়নশীল তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলিতে দেখা যায় । ভারতে ডেঙ্গু দমদম ফিভার নামেও,পরিচিত ছিল । প্রোটিনের উপস্থিতির উপর নির্ভর করে ডেঙ্গুকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন : NS1, NS2a, NS2b, NS3, NS4a, NS4b, NS5। ডেঙ্গুর বাহক হল স্ত্রী এডিস মশা ।এডিস মশা সাধারণত পরিষ্কার জমা জলে জন্মায় এবং দিনের বেলায় অর্থাৎ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কামড়ায় ।ডেঙ্গু আক্রমণের 3-4 দিনের মধ্যে রোগলক্ষণ প্রকাশ করে এবং 7-12 দিন রোগীর দেহে স্থায়ী হয়, আবার অনেক ক্ষেত্রে রোগ নির্দিষ্ট কিছু সময় পর রোগ ফিরে আসে ।
ডেঙ্গুর রোগলক্ষণ ও অন্যান্য মশাবাহিত রোগের রোগলক্ষণ প্রায় এক হয়, যার ফলে রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে অসুবিধা দেখা যায় । সাধারণ ক্ষেত্রে, জ্বর, বমি, ক্ষুধা হ্রাস পায়, হাতে পায়ে এবং শরীরের অনন্য অঙ্গে ব্যাথা হয় বিশেষত চোখের মণি ও তার পিছনে ব্যাথা গত কিছু বছরের নতুন রোগ লক্ষণের উদয় হয়েছে ।
ডেঙ্গুর সবচেয়ে ভয়ানক রোগলক্ষণটি হল রক্তের অণুচক্রিকার সংখ্যা হ্রাস, যার ফলে রক্ত তঞ্চন বিলম্বিত হয়ে পড়ে ।অনেকক্ষেত্রেই রক্তক্ষরণ এত বেশি পরিমানে হয় যে আক্রান্তের মৃত্যু পর্যন্ত হয়, এছাড়াও রক্ত চাপ এবং পালস রেট কমে যাওয়াও পরিলক্ষিত হয় । সারা দেহে লাল রেশ বা গোটা দেখা যায় ।
ডেঙ্গুর 4টি শ্রেণীবিভাগ আছে, যথা টাইপ 1, টাইপ 2, টাইপ 3, টাইপ 4 এবং 2013 সালে ডেঙ্গুর আর একটি ভাগ অর্থাৎ টাইপ-5 পাওয়া গেছে, ডেঙ্গু হিমারেজিক (DHF) ফিভার ভারতে দেখা যায় এবং ডেঙ্গু সক সিনড্রোম (DSS) যা খুব একটা ভারতে দেখা যায় না, এবং DSS এই মৃত্যু সবচেয়ে বেশি ।
ডেঙ্গুর এই ব্যাপকতার জন্য আমাদের জীবনযাত্রাই অনেকটা দায়ী, ডেঙ্গু মশা জমা জলে জন্মায় এবং এই জমা জল আমাদের অবহেলা এবং অজ্ঞানতার ফল আর কিছুটা আমাদের অতিআধুনিকতার উপজাত ।আমরা আগে শালপাতার থালায় বা মাটির খুড়িতে খেতাম যা ফেলে দিলে ভেঙে যেত, কিন্তু এখন কাগজের কাপ বা থার্মোকলের থালা বাটি এবং প্লাস্টিকের গ্লাস জল জমার আধার হিসেবে কাজ করছে যার ফলে প্রচুর পরিমানে মশা তাতে জন্ম নিচ্ছে, এই জিনিসগুলি অনেক টাই আমাদের হাতে আছে আমরা একটু সচেতন হয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতেই পারি ।
ডেঙ্গুর একটি চক্র আছে, যে অঞ্চল ডেঙ্গু পীড়িত হয় ; সেখানে পাঁচ বছরের মধ্যে পুনরায় আর একবার ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা যায় । সাধারণ রক্ত পরীক্ষা ছাড়া একমাত্র EISA রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ডেঙ্গু নির্ণয় করা যায় এবং দ্রুত রোগ নির্ণয় ও তাৎক্ষণিক চিকিৎসার সাহাায্যে রোগ সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব ।ডেঙ্গুর মশার দংশনের হাত থেকে বাঁচার জন্য মশারি, মসকিউটো রেপেলেন্ট আর অন্য যেসব মশা নিবারণের উপায় আছে সেগুলি অবলম্বন করতে হবে, জল জমতে দেওয়া বন্ধ করতে হবে । ডেঙ্গুর ক্ষেত্রেও অনেক মিথ প্রচলিত আছে, যেমন প্রচুর পরিমানে জল খাওয়া বা পেঁপে খাওয়া,এগুলি না করে, চিকিৎসা বিজ্ঞানে ভরসা রাখাই ভালো ।
তাই জ্বর স্থায়ী হলেই, ডাক্তার দেখান এবং রক্ত পরীক্ষা করুন ও চিকিৎসকের আশু পরামর্শ নিন,আর প্রয়োজনীয় সচেতনতা এবং বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ নিলেই রোগ সম্ভাবনা হ্রাস পাবে, কারণ prevention is better than cure .
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের আর একটি আত্মক হল, স্ক্রাব টাইফাস এটিও একটি আর্থোঘটিত রোগ । ডেঙ্গির প্রকোপ তো ছিলই। এবার গোদের উপর বিষফোঁড়া স্ক্রাব টাইফাস। এতদিন যা গ্রাম বা মফঃস্বলে সীমাবদ্ধ ছিল, তাই এখন ছড়াচ্ছে কলকাতায়। গত তিন মাসে স্ক্রাব টাইফাসে আক্রান্ত প্রায় দেড় হাজার, জেলায় আক্রমণের সংখ্যা এবং মৃত্যুহার অত্যন্ত বেশি, হুগলির বৈদ্যবাটি ও হাওড়ার বালিতে একাধিক আক্রমণ এবং মৃত্যুর ঘটনা জানা গেছে, এছাড়াও উত্তরবঙ্গও ব্যাপক আক্রমণের শিকার হয়েছে ।
টাইফাস বা টাইফাস, এই নামের উৎপত্তি হয়েছে গ্রিক শব্দ typhus (τύφος) থেকে যার অর্থ ধোঁয়াটে বা অস্পষ্ট যার দ্বারা এই রোগে আক্রান্তদের মনের অবস্থা বুঝায়। এই জ্বরের জন্য দায়ী জীবাণু রিকটশিয়া কে বলা হয় অবলিগেট ইন্ট্রাসেলুলার ব্যাক্টেরিয়া অর্থাৎ এরা জীবন্ত কোষের বাইরে এরা বেশিক্ষণ বাঁচে না। এই জীবাণু মানব শরীরে ছড়ায় মূলত বাহ্যিক পরজীবী যেমন উকুন,কীট (ট্রিক এবং মাইট ) ইত্যাদির মাধ্যমে। টাইফাস ও টাইফয়েড দুটি আলাদা ব্যাক্টেরিয়া দ্বারা ঘটিত ভিন্নধর্মী রোগ। জীবাণু সংক্রমণ হওয়ার প্রায় ১-২ সপ্তাহ পর ঠাণ্ডা ও কাঁপুনিসহ আকস্মিক জ্বর, মাথাব্যথা ও অন্যান্য জ্বরের মত উপসর্গ হয়।
লক্ষণ শুরুর ৫ থেকে ৭ দিন পর দেহে বসন্তের মতো কিন্তু আকারে ছোট গোটা বা রেস দেখা দেয় যা হাত ও পায়ে ছড়ায় তবে মুখমণ্ডলে হয় না। চিকিৎসা সহজ। খরচও কম। শুরুতে ধরা পড়লে অ্যান্টিবায়োটিকেই সেরে যায়। কিন্তু রোগ নির্ণয় করতে করতেই অনেকটা দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাই গত কয়েকবছর ধরে রাজ্য জুড়ে বাড়ছে স্ক্রাব টাইফাসের প্রকোপ। জ্বর, মাথাব্যথা, ঝিমুনি ভাব। মাঝেমধ্যে খিঁচুনি।
স্ক্রাব টাইফাসের লক্ষণ অনেকটা ডেঙ্গির মতোই। অনেক সময় ডেঙ্গির চিকিৎসা শুরুর পরে ধরা পড়ছে স্ক্রাব টাইফাস। তাই অজানা কোনো পোকা কামড়ালেই অতি সত্তর চলে যান নিকটবর্তী হাসপাতালে এবং রোগ নিরাময় করুন, একটু সজাগ দৃষ্টি এবং সাবধানতা অনেকটা কাজ করে দিতে পারে।



One thought on “আতংকের দুই নাম:”