২০১৮-এর নভেম্বরের শেষ দিকে উত্তরবঙ্গে ছােটখাটো হাঁটাহাঁটির চিন্তা মাথায়
ঘরছে। হঠাৎ মনে হল খুব ছােট কিমি চারেক জঙ্গলে হাঁটা। হ্যা, ভারেং থেকে মাত্র
৪ কিমি হেঁটে আমরা পৌছব গাের্কে। সঙ্গে ২ কিমি পাহাড় চিড়ে পৌঁছে যাৰ সামানদেন গ্রাম।
সেইমত চিন্তাভাবনা শুরু হল। টিকিটও কেটে নেওয়া হল তিস্তা-তাের্সা এক্সপ্রেসে।
রাত ২টো ৪০ মিনিটে সঠিক সময়ে এনজিপি পৌছে দিয়ে তিস্তা-তাের্সা তার
গন্তব্যে এগিয়ে চলল। আমরা ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষা করে ৪টে ৩০ মিনিট নাগাদ স্টেশনের
বাইরে এসে জোড়থাংগামী একটি গাড়ি বুক করলাম, আমরা ছয় জন। গাড়ি ভাড়া
২৫০০ টাকা। শীতের আমেজ মাখা সকালে বড় মনােরম যাত্রা শুরু হল। প্রায় ৮টা
নাগাদ আমরা জোড়থাং বাজারে পৌছে গেলাম।
এবার আমাদের গন্তব্য জোড়থাংথেকে রিবধি হয়ে ভারেং। আসলে রিবধি আর ভারেং নদীর দু-পারে দুটি গ্রাম। যেন টুইন ভিলেজ।
আমরা জোড়থাং থেকে শেয়ার জিপে ভারেং পর্যন্ত জনপ্রতি ১৫০
টাকায় জিপ ভাড়া করে এগিয়ে চললাম। গাড়িতে আমাদের ছয়জন বাদেও বেশ কয়েকজন
স্থানীয় মানুষ রয়েছে। নিজেদের মধ্যে ছােটখাটো আলােচনা, সঙ্গে বর্ষায় সবুজ হয়ে
ওঠা প্রকৃতিকে দেখতে দেখতে এক মিষ্টি আনন্দে মনটা ভরে উঠল। মনে পড়ল বছর
দশেক আগে রিবধি গ্রামে রাতে ছিলাম। সেজন্য এবার আরও ৩ কিমি এগিয়ে ভারেং
গ্রামে রাত কাটাব। তারপর আবহাওয়া ভাল পেলে সকাল সকাল অবশিষ্ট ৪ কিমি
হেঁটে অসাধারণ সুন্দর জঙ্গল পথ পেরিয়ে পৌছে যাব গাের্কে খােলার গা বেয়ে গাের্কে গ্রামে।
যাইহােক, ভারেং-এ এখন অনেক হােমস্টে। পছন্দসই একটি হােমস্টেতে
উঠলাম। অফ সিজন হওয়াতে এখন ভাড়া একটু কম। পাহাড়ের এক ঢালে আমাদের
হােমস্টে। বড় সুন্দর পরিবেশে বেশ পরিচ্ছন্ন। সব ঘরগুলােই সুন্দর। দুপুরে খাওয়া
দাওয়া সেরে গ্রামের পথে পা বাড়ালাম। বর্ষায় গ্রামের শােভার পরিবর্তন হয়েছে।
সমস্ত গাছপালা যেন হালকা সবুজ, কালচে সবুজ আরও নানা রকমারী সবুজে আচ্ছন্ন।
মাঝে মাঝে রােদের ঝলকে পাহাড়ি পরিবেশে যেন এক মায়াবী চেহারা। ধীরে ধীরে
সন্ধ্যা নেমে এল। এখন গাের্কেতে প্রচুর হােমস্টে। সিজন অনুযায়ী ৮০০ টাকা থেকে
১৫০০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া। আমরা বেশ সকাল সকাল ৬টা নাগাদ বেরিয়ে পড়েছি
ভারেং গ্রাম ছেড়ে জঙ্গল পথে। নিশ্চিদ্র জঙ্গল। অসংখ্য পাখ-পাখালীর কলরব। আকাশ
মেঘাচ্ছন্ন। দ্রুত চলেছি যাতে বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। পথ শােভা
অসাধারণ। তবে বর্ষায় পথ কিছুটা পিচ্ছিল। ট্রেক পথের মজা নিতে গল্প করতে করতে
এগিয়ে চলেছি। ধীরে ধীরে পৌছে গেলাম গাের্কে খােলার ধারে। গাের্কে খেলার উপর
ছােটো ব্রীজটি নীল-সাদা রঙ করা। বুঝলাম আমরা সিকিম ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ
করছি। খােলা পেরিয়ে কাঠের সুন্দর সুন্দর বাড়ি। বেশকিছু বাড়িতে হােমস্টে চালু
হয়েছে। এছাড়া রয়েছে অপূর্ব সুন্দর ট্রেকার্স হাট।
ট্রেকার্স হাট সংলগ্ন অঞ্চলে প্রকতি
যেন অকৃপণ, উজার করা সৌন্দর্যে। এক সুন্দর ছবির মত গ্রাম। কিছুক্ষণ ইতস্তত
হাঁটাচলা, ঘােরাঘুরি সেরে আশ্রয় নিলাম ট্রেকার্স হাটে। দুপুরের খাওয়া সেরে ছােট্ট
গোর্কে গ্রাম প্রদক্ষিণ সেরে এগিয়ে চললাম ঘন জঙ্গল ঘেরা চড়াই পথে সামানদেন
গ্রামে। পাহাড়ের উপর সমতল জায়গা। চতুদিকে ফসলের খেত। টুকরাে টুকরাে জমিতে
নানারকম ফসল হয়েছে। সুন্দর সবুজ সতেজ সমতল জমিতে নানারকম চাষ-আবাদ
হয়েছে কিছু পাকা বাড়িও রয়েছে। তবে হােমস্টে সেভাবে নজরে এল না। মনে পড়ল
প্রায় ৮-১০ বছর আগে এই পথেই ফালুট থেকে গাের্কে নেমেছিলাম। তবে গাের্কের
আবহাওয়া চমৎকার। এই বর্ষাতেও আবহাওয়াতে কোনাে গরমের ভাব নেই। শুধু
রােদ, মেঘ-কুয়াশার মাঝে গাের্কে খােলার অবিরাম বয়ে যাওয়ার শব্দ, আর পাখীর
কুজন। এইভাবেই সুন্দর প্রকৃতির কোলে গাের্কের একটি দিন কেটে যায় সুখস্মৃতিতে।
রাতটা গাের্কেতে কাটিয়ে বেশ ভােরেই একই পথে ভারেং হয়ে রিবধি, রিবধি থেকে
জোড়থাং হয়ে এনজেপি। মনে হল কি পেলাম দুদিনে? গত দুদিনে পেলাম মনােরম
সবুজ প্রকৃতি, কিছু সহজ-সরল মানুষের সান্নিধ্য, ঘন কুয়াশা আর কখনও কখনও
ইলশেগুড়ির মাঝে হেঁটে বেড়ানাের আনন্দ। যাইহােক ছােট ছােট হাঁটার মাঝে আবার
আসবে আমন্ত্রণ নিয়ে ফিরে চললাম শহুরে পরিবেশে।।
প্রয়ােজনীয় তথ্য :
যাওয়ার সঠিক সময় নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস।
কিভাবে যাবেন ?
কলকাতা থেকে এনজেপি। সেখান থেকে বাসে বা গাড়ি ভাড়া করে জোড়থাং।
জোড়থাং থেকে শেয়ার জিপে ভারেং। গাড়িভাড়া এনজেপি থেকে ভারেং মােটামুটি
৪০০০ টাকা। এনজেপি থেকে শেয়ার জিপে জোড়থাং ২০০ টাকা। জোড়থাং থেকে
ভারেং জন প্রতি ১৫০ টাকা। রিধবি -ভাবেং-এ অনেক হােমস্টে রয়েছে। ৮০০ টাকা
থেকে ১২০০ টাকা জন প্রতি প্রতিদিন।
গাের্কেতে থাকার জায়গা :
গােঘা হিল কাউন্সিল অফিস, ৪নং এ্যাম্বেসি বিল্ডিং প্রথম তল, শেক্সপিয়ার
সরণি, কলকাতা – ৭০০০৭১। এছাড়া গাের্কেতে বেশকিছু হােমস্টে রয়েছে। ভাড়া
৮০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত।
প্রবীর বসু