আজ মকর সংক্রান্তি। পৌষ মাসের শেষ তথা একটি উৎসবের দিন। গোটা দেশ জুড়ে বিভিন্ন নামে ও বিভিন্ন ভাবে দিনটি পালন করা হয়। ‘সংক্রান্তি’ কথাটি এসেছে ‘সংক্রমণ’ থেকে। বছরের এই সময় সূর্য ধনু রাশি থেকে মকর রাশিতে সংক্রমিত হয়। মকর রাশিতে সূর্যের সংক্রমণের সাথে সূর্যের উত্তর দিকে সরে আসা বা উত্তরায়ণ শুরু হয়। তাই আজকের দিনটিকে উত্তরায়ণ সংক্রান্তিও বলা হয়।
মহাভারত অনুসারে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে শরশয্যায় শায়িত পিতামহ ভীষ্ম উত্তরায়ণ সংক্রান্তির দিন প্রাণ ত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করেন ও সেই দিন প্রাণ ত্যাগ করেন। তাঁর শেষ কৃত্য সম্পন্ন করে পঞ্চপান্ডব তিল খেয়ে গুরুজনদের হত্যা করার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করেন। ভারতের কিছু অঞ্চলে দিনটি ‘তিলকূট’ বা ‘তিল সংক্রান্তি’ নামেও পরিচিত।
আসামের বরাক উপত্যকায় তিল সংক্রান্তি নামটির প্রচলন আছে। আসামে দিনটি ‘ভোগালী বিহু’ নামে পরিচিত । পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে পিঠে পুলি বানানো ও খাওয়া হয় । বছরের এই সময় পূর্ব ভারতে খেতের ফসল চাষীর গোলায় উঠে যায় । হাতে দুটো পয়সা আসে । চাষীর ঘরে আনন্দের যোয়ার আসে । উদ্বৃত্ত ফসল থেকে পিঠে পুলি তৈরি হয় । সবাই মিলে সেটা ভোগ বা খাওয়া দাওয়া করা হয় । তাই নাম ভোগালী বিহু । আমার ছোট বেলায় বাড়িতে নানা ধরনের পিঠে পুলি তৈরি হতে দেখেছি । এই পিঠে তৈরিতে নারকেল ও তিলের বিশেষ ভূমিকা আছে। আসামে বিন্নি ধানের চালের,( যাকে বিরোন চাল বলে,)গুড়ো ও তিল দিয়ে এক ধরনের পিঠে তৈরি হয়। পিঠের নাম তিল পিঠা। অনেকটা পাটিসপ্টার মত। এই পিঠা তৈরি করা হয় চালের শুকনো গুড়ো দিয়ে। বিরোন চালের মধ্যে একটা আঠালো ভাব আছে তাই জলে না গুললেও চলে । আমার মা এই তিল পিঠা খুব নরম করে তৈরি করতে পারতেন । অনেক অসমীয়া বাড়িতে আমি এই পিঠে খয়েছি তবে সেই পিঠে খুব শক্ত হয় ।
পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে শুধু যে পিঠে তৈরি হত তা নয়। শীতের সব্জি ও মাছ দিয়ে অনেক রকমের পদ তৈরি হত । খাওয়া দাওয়া ছাড়াও অন্যান্য বিনোদনের আয়োজন হয় এই সময় । আসামে মোষের লড়াই একটি বড় বিনোদন ।
পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া ও মেদিনীপুর অঞ্চলে ষাঁড়ের লড়াইয়ের আয়োজন হয় । স্থানীয় ভাবে এই অঞ্চলে ষাঁড়কে ‘কাঁড়া’ বলা হয় । এই লড়াই কাঁড়ার লড়াই নামেও প্রসিদ্ধ ।
গুজরাটে মকরসংক্রান্তি উপলক্ষে ঘুড়ি ওড়ানো হয় যাকে বলা হয় কাইট ফেস্টিভ্যাল। বিশ্বের অনেক দেশ থেকে মানুষ আসেন তাদের নিজের নিজের দেশের বিচিত্র ধরনের সব ঘুড়ি নিয়ে গুজরাটের কাইট ফেস্টিভ্যালে যোগ দিতে । মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে ভারতের প্রায় সর্বত্র নদ নদী ও বিভিন্ন সমুদ্রে মানুষ স্নান করেন পৃন্য লাভের আশায় ।
আসামের উত্তর পূর্ব প্রান্তে পরশুরাম কুন্ড ও পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপে মেলা বসে । সাগরদ্বীপের মেলায় লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম হয় । সাগরে স্নান করে মানুষ পূণ্যলাভ করেন । সময়ের সাথে সাগর মেলার শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে । আগে সাগর মেলায় যাওয়া যথেষ্ট কষ্টকর ছিল । এখন যাতায়াত ব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে । আগে সাগর মেলায় ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের বিশেষ করে উত্তর ভারতের স্বল্পবিত্ত গ্রামীণ মানুষ জন অধিক সংখ্যায় আসতেন। অবশ্য এখনও বড় সংখ্যায় তারাই আসেন । এখন একটু সম্পন্ন পরিবারের ও শহরের মানুষের মধ্যেও সাগর মেলায় আসার প্রবণতা বেড়েছে । সাগর দ্বীপে কপিল মুনির আশ্রম ঘিরে মেলায় আয়োজন হয় ।
বছর ২০/ ২২ আগে আমি একবার গঙ্গাসাগর বা সাগর দ্বীপে গিয়েছিলাম। ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে অফিসের কাজে কাকদ্বীপ অঞ্চলে গিয়েছিলাম । কাজের ফাঁকে কিছু সময়ের জন্য সাগর দ্বীপে গিয়েছিলাম । তখন মেলার প্রস্তুতি চলছিল । ব্যবস্থাপত্রও তেমন ভালো ছিল না । শুনেছি এখন থাকা খাওয়ার ভালো ব্যবস্থা হয়েছে । সাগর মেলা ও পরশুরাম কুন্ডের মেলার পেছেনে যে পৌরাণিক কাহিনি রয়েছে সময়াভাবে সেই গল্প বলা থেকে বিরত রইলাম । সবাই পিঠেপুলি খান । দিনটি সুন্দর ভাবে উপভোগ করুন । তিনি বলেছেন আজ সন্ধ্যায় পাটিসাপ্টা তৈরি করবেন । তার প্রস্তুতিও সারা হয়ে গেছে । এ কথা জোর দিয়ে বলতে পারি আমার গৃহিণীর মত ভালো সুস্বাদু পাটিসাপটা আমাদের এ তল্লাটে আর কেউ বানাতে পারেন না । তবে আফসোস একটাই আমাদের প্রজন্মের মহিলারাই শেষ প্রজন্ম । পরের প্রজন্মের মেয়েদের মধ্যে পিঠে পুলি তৈরি করার মত ইচ্ছে ও স্কিল কোনটাই নেই । আমাদের প্রজন্মের এখন যারা মা দিদা ঠাকুমা আছেন তাদের পর দোকান থেকে কিনে খেতে হবে। বাড়িতে তৈরি হবে না ।
অজয় নাথ