একদিন বর্ষার দিনে দুপুরবেলা বেরিয়ে পড়েছিলাম পাখির ছবি তুলব বলে,
জায়গাটা আমার বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয় হালিসহরের রেলবাউন্ডারির কাছাকাছি,
এমনিতেই সেদিন ভালাে আলাে ছিল না, অনেকক্ষণ ঘােরাঘুরির পর যখন নিরাশ হয়ে
বাড়ির পথে পা বাড়াবাে বলে ঠিক করেছি, ঠিক তখনই দেখা পেলাম দ্রুত বালির
উপর দিয়ে যেন কি একটা পাখি দৌড়ে চলেছে। এত তাড়াতাড়ি এই পাখি দৌড়াচ্ছিল যে কম আলােতে ঠিকবুঝতে পারছিলাম না এটা কি পাখি। যখন ওর কাছাকাছি এসে
পৌছালাম তখন বুঝতে পারলাম এটা হলাে লিটিল রিংগড-প্লোভার, বাংলায় যাকে
বলা হয় জিরিয়া পাখি। এই পাখির বৈজ্ঞানিক নাম হল চারাদিয়াস ডুবিয়াস।
আমাদের আশেপাশে যে সমস্ত নদী, পুকুর, ঝিল, অগভীর জলাশয় বা নদীর
পাড়ে বালুর চর আছে সেই সমস্ত জায়গাতে এই পাখির দেখা মিলতে পারে। আমার
খুব মন পড়ছে কেঁদুলির মেলা দেখতে গিয়ে দুপুরবেলা আমরা অজয় নদীর তীরে
পৌছেছিলাম, নদীর পাড় ধরে ঘােরার সময় দ্বিতীয়বার এই পাখির দেখা পেয়েছিলাম।
এরপর এই পাখির দেখা অনেকবারের জন্য পেয়েছি।
ভারি সুন্দর দেখতে হয় এই পাখি। কালাে গােলাকৃতি বড় চোখের চারপাশে
হলুদ রঙের একটা বলয় থাকে, মনে হবে যেন এই পাখির চোখে কেউ হলুদ ফ্রেমের
রােদ চশমা পড়িয়ে দিয়েছে। গলার দিকে যদি একটু লক্ষ্য করা যায় তবে দেখা যাবে
সাদা ও কালাে রঙের একটা পট্টি যেন ওর গলায় মাপলারের মতন জড়িয়ে আছে।
কালাে পট্টি কপালের দুপাশে চোখ পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। দেহের উপরের অংশের রঙ
হালকা বাদামি রঙের এবং দেহের সামনের দিকের অংশ সাদা রঙের হয়ে থাকে। এই
পাখির কালাে ঠোট দুটি দেহের আকারের তুলনায় একটু ছােটই হয়ে থাকে।
এই পাখি আকারে খুব একটা বেশি বড় হয় না, লম্বায় সাধারণত ১৫-১৭ সেন্টিমিটার হয়ে
থাকে এদের পা দুটি হলুদ বর্ণের হয়ে থাকে এবং পা দুটি খুব মজবুত হয়। সারাদিনের
বেশিরভাগ সময় এরা হেঁটে বেড়াতে ভালােবাসে। এরা যখন এক জায়গা থেকে আর এক
জায়গাতে উড়ে যায় তখন স্ত্রী জিরিয়া পাখি সকল সময়ের জন্য পুরুষ পাখিকে সঙ্গ
দেয়। যখন এরা বালির উপর বা মাটির উপর দিয়ে হাঁটে তখন এদের হাঁটার গতি
ঘণ্টায় প্রায় ২০-২৫ কিলােমিটার হয়ে থাকে। এদের ওড়ার গতিবেগ আরও অনেক
বেশি, উড়ার সময় এরা ঘণ্টায় প্রায় ৫০-৬০ কিলােমিটার বেগে উড়ে।
আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গাতে এরা বিচরণ করে। খােলা
আকাশের নিচে কাদামাখা জলাজমি যেখানে পায়, সেখানে এই পাখি মার্চ-মে মাসের
মধ্যে ২-৪টি ডিম পাড়ে। ডিমগুলাে হালকা হলুদ রঙের হয় এবং আকারে কিছুটা
লম্বাটে ধরনের হয়ে থাকে। শুধু তাই নয় ডিমের উপর হায়ারােগ্লিফিক লিপির মত
গাঢ় বাদামী বর্ণের চিত্রকলা মােজায়েক করা থাকে। যখন এরা বাসা বানায় তখন পুরুষ
পাখি ১০-১২ দিন আগে নির্দিষ্ট স্থানে এসে হাজির হয়। এরপর শুরু হয় পুরুষ পাখির
ডাকাডাকি করে স্ত্রী পাখিকে কাছে নিয়ে আসা। শুধু তাই নয় আগের বারের স্ত্রী সঙ্গ
পাখিটিকেও পুরুষ পাখি ডেকে এনে হাজির করে এবং সবাই মিলে এরা বাসা ও ডিমের
যেন কোনও ক্ষতি না হয় সে বিষয়ে এরা সজাগ থাকে। এদের ডিমের রঙ এমন হয়
যে মাটির রঙের সাথে একেবারে মিশে যায় চট করে এই ডিমের হদিশ পাওয়া খুব
মুশকিল। অনেকভাবেই এদের উপর শত্রুর আক্রমণ হতে পারে। এদের ডিম কাক,
কুবাে পাখি, শিয়াল সুযােগ পেলে খেয়ে ফেলে। তবে একটা রক্ষা, মানুষ এই পাখির
মাংস খায় না। মনে হয় এই পাখির মাংস সুস্বাদু নয়। শিকারীদের হাত থেকে এদের
ডিমগুলিকে রক্ষা করার জন্য এরা বাসা থেকে দূরে এদের দেহকে এমনভাবে নাড়তে
থাকে যে মনে হয় ডিমগুলাে যেন ওই অবস্থানেই আছে। শিকারীদের দৃষ্টিভ্রম করার
জন্য এরা এরকম পন্থা অবলম্বন করে। এদের এরকম বুদ্ধির অবশ্যই তারিফ পাওয়ার
যােগ্য।
খাবারের জন্য এরা কাদাভূমির চারদিকে ঘুরে বেড়ায়, এখান থেকে বিভিন্ন
পােকামাকড়, কেঁচো, ছােটো কাঁকড়া খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। খাদ্যের প্রয়ােজনে এরা
সবসময়ের জন্য জলাভূমির বা কাদামাখা জমির কাছাকাছি অবস্থান করে।
তবে চারিদিকে যেভাবে জলাভূমি বুজিয়ে ফেলা হচ্ছে সুদূর ভবিষ্যতে এদের
দেখা পাওয়া হয়তাে মুশকিল হয়ে পড়বে। একদিন এমন একটা সময় আসবে যেদিন
এদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে। সময় থাকতে থাকতে মনে হয় এই বিষয়ে আমাদের
একটু সচেতন হওয়া উচিত। আসুন আমরা সবাই মিলে এদেরকে রক্ষা করি না হলে
ভবিষ্যতে আর আমরা এদের দেখা পাবো না।
– তাপস কুমার দত্ত