১৮৯৫ সালের ৮ই নভেম্বর। অস্তগামী সূর্যের আলােয় লালাভ পশ্চিম দিগন্ত। হিমেল বাতাস চারদিকে। অন্ধকার গবেষণাগারে গবেষণায় মগ্ন রনটজেন। জার্মান পদার্থবিদ উইলহেম কনরাড রনটজেন। তিনি ব্যস্ত ছিলেন একটি হিট্টোফ টিউব চালানাের কাজে। টিউবটির পুরােটাই ছিল কালাে কার্ডবাের্ড দিয়ে ঢাকা। টিউবটির কাছে টাঙানাে ছিল একটি পর্দা। পর্দাটি বেরিয়াম প্লাটিনােসায়ানাইড মাখানাে। হঠাৎ-ই রনটজেন লক্ষ করলেন, পর্দাটিতে প্রতিভার সৃষ্টি হয়ে আলাে বেরােচ্ছে। কী ব্যাপার! এক অদ্ভুত বিস্ময়ে নিক্ষিপ্ত হলেন বিজ্ঞানী। ভাবতে লাগলেন, নিশ্চয়ই পর্দার ওপর কোনও কিছু আঘাত করছে। কিসের আঘাত?
প্রথম এক্স রে ছবি
টিউবটি তাে কালাে কার্ডবাের্ড ঢাকা, টিউবটি থেকে কোনও আলাে বা ক্যাথােড রশ্মিও তাে বেরিয়ে আসার কথা নয়। বিস্মিত রন্টজেন কিছুটা হতবুদ্ধি হয়ে যান। কী করবেন যেন ভেবে উঠতে পারছেন না। পর্দার যে দিকটাতে বেরিয়াম প্ল্যাটিনােসায়ানাইড মাখানাে নেই, সেই দিকটাকে ঘুরিয়ে দিলেন পর্দার দিকে। প্রতিপ্রভা দেখা গেল।পর্দাটিকে দূরে সরিয়ে, টিউবের কাছে এনে, পর্দা ও টিউবের মাঝে
নানা বস্তু রেখে; পরীক্ষাটি করলেন। কী আশ্চর্য! একই ফল, একই ঘটনা। টিউব ও পর্দার মধ্যে এবার নিজের হাত রাখলেন। পর্দার ওপর হাতের হাড়ের ছবি ভেসে উঠলাে। এ এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগৎ পেল এক অমূল্য আবিষ্কার। রনটজেন তখনও ভেবে উঠতে পারেন নি যে, তাঁর এই আবিষ্কার মানব কল্যাণে কি ব্যাপকভাবে কাজে আসবে। অবশ্য সেই মুহর্তে এতদুর না ভাবতে পারাটাই স্বাভাবিক। গবেষণাগারে রনটজেন একাই কাজ করতেন।গবেষণাগারে রন্টজেন কাউকে কিছু না জানিয়ে তিনি একাই নানাভাবে পরীক্ষাটি করে চললেন। তিনি আরও লক্ষ করলেন, বিভিন্ন বস্তু বিভিন্ন মাত্রায় তার
নতুন রশ্মিতে স্বচ্ছ। ফোটোগ্রাফিক প্লেটে ছবি তুলে নিজের আবিষ্কার সম্পর্কে নিশ্চিত হলেন।
১৮৯৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর তারিখে ভৌত চিকিৎসা সােসাইটির সম্পাদকের কাছে তিনি তার আবিষ্কারের একটি প্রাথমিক রিপাের্ট দাখিল করলেন। রিপাের্টে রনটজেন বললেন, If we pass the discharge from a large Rumkorff coil through Hittrof or a sufficiently exhausted Lennard, Crookes or
similar apparatus and cover the tube with some what closely fitting mantle of their black cardboard, we observe in a completely dark room that a paper screen covered with barium platino cynide lights up brilliantly and fluoresces equally well whether the treated side or the other be turned towards the discharge tube. রিপোর্টটি ছাপা হল। ১৮৯৬ সালের জানুয়ারি মাসের গােড়ায় রিপাের্টটি পৌঁছে গেল অনেকের কাছে। রনটজেন এই নতুন রশ্মির নাম দিলেন X- ray (এক্স রশ্মি)। ১৯৯৬ সালের ২৩ জানুয়ারি তারিখে এক প্রকাশ্য সমাবেশে রন্টজেন ঘােষণা করলেন তাঁর এক্স রশ্মি আবিষ্কারের কথা। বহু বিজ্ঞানী তাদের গবেষণাগারে এক্স রশ্মি উৎপাদনের ব্যাপারটি যাচাই করে দেখলেন। রন্টজেনের বক্তব্যের সমর্থন মিলল সকল ক্ষেত্রেই। পদার্থবিদ্যায় প্রথম নােবেল পুরস্কারটি পৌছল রনটজেনের কাছে ১৯০১ সালে।
এক্স রশ্মির আবিষ্কার, উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকের ঘটনা। বলা যায়, বিংশ শতাব্দীর জন্মলগ্নের যুগান্তকারী আবিষ্কারগুলির মধ্যে এক্স রশ্মির আবিষ্কার অন্যতম। তাত্ত্বিক ও প্রযুক্তিগত সব দিক দিয়েই
অগ্রগতির অবিচ্ছিন্ন ধারায় সমুজ্জ্বল এই শতাব্দী। বিরাট সব ব্যক্তিত্ব ও তাদের গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে অনেকখানি। মানব সভ্যতার কল্যাণে সরাসরি কাজে লেগেছে কোনাে কোনাে আবিষ্কার, আবার কোনাে আবিষ্কার মানব কল্যাণে কাজে লেগেছে পরােক্ষভাবে। কোনাে আবিষ্কারের সুফল পাওয়া গেছে আবিষ্কারের অল্প দিনের মধ্যেই, আবার কোনাে ক্ষেত্রে সুফল পেতে
অপেক্ষা করতে হয়েছে বহুদিন। এক্স রশ্মি ওই প্রথম শ্রেণিটির মধ্যে পড়ে।
এক্স রশ্মি আসলে কি? ঠিক কিভাবে তৈরী হয় এক্স রশ্মিা ? এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন নি বিজ্ঞানী রনটজেন। প্রায় ষােল বছর কেটে গেছে এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে। এ ব্যাপারে সফল বিজ্ঞানীরা হলেন ম্যাক্স ফন লাওয়া, পি আগার, মােজলে প্রমুখ। এঁদের কাজে বােঝা গেল, এক্স রশ্মির আচার ব্যবহার অনেকাংশে আলাের রশ্মির মতই, যদিও গুরুত্বপূর্ণ কিছু পার্থক্যও আছে। সেই পার্থক্যের কারণ নিহিত আছে তাদের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পার্থক্যে। এক্স রশ্মি যে তরঙ্গমালায় গঠিত, তাদের তরঙ্গদৈর্ঘ্য মােটামুটিভাবে ০.১ থেকে ১০০ অ্যাংস্ট্রমের মধ্যে। দৃশ্যমান আলাের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তুলনায় এক্স রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য খুবই কম, প্রায় ১০০০ ভাগের ১ ভাগ মাত্র। দৃশ্যমান আলাের মতই এক্স রশ্মি এক ধরনের তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ। এক্স রশ্মির ক্ষেত্রেও প্রতিফলন, প্রতিসরণ, ব্যতিচার, সমবর্তন ইত্যাদি তরঙ্গধর্ম পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে। আবিষ্কারের সময় থেকেই এক্স রশ্মি বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। চিকিৎসাক্ষেত্রে রােগ নির্ণয়ে এবং রােগের নিরাময়ে এক্স রশ্মি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এক্স রশ্মি দেহের মাংস ভেদ করতে পারে, কিন্তু হাড় ভেদ করতে পারে না। এক্স রশ্মি ফোটোগ্রাফিক প্লেটকে প্রভাবিত করতে পারে। এই দুই ধর্মের প্রয়ােগে দেহের ভিতরের বিভিন্ন অংশের রেডিয়ােগ্রাফ করতে এক্স রশ্মি ব্যবহার করা হয়। দেহের
কোনাে অংশের হাড় ভেঙে গেলে ভাঙা হাড়ের অবস্থান, দেহের ভিতরে কোনাে অবাঞ্ছিত বস্তু থাকলে তার অস্তিত্ব, কিডনি বা গলব্লাডারে পাথর (?) হলে তার অস্বিত্ব, আলসার বা টিউমারের অস্তিত্ব জানার জন্য এক্স রশ্মি ব্যবহার করা হয়। এক্স রশ্মি জীবিত কোষকে ধ্বংস করে এই ধর্মকে কাজে লাগিয়ে এক্স রশ্মির সাহায্যে টিউমার, চর্মরােগ প্রভৃতির চিকিৎসা করা হয়। দাঁতের চিকিৎসাতেও এক্স রশ্মি ব্যবহার হচ্ছে।
কারিগরি বিজ্ঞানে এবং আধুনিক শিল্পে এক্স রশ্মির প্রয়ােগ আছে।এক্স রশ্মির সাহায্যে ঢালাই করা ধাতু সামগ্রী, ছাঁচ, ঝালাই ইত্যাদির ত্রুটি পরীক্ষা করা হয়। উপরন্তু, উৎপন্ন দ্রব্য সামগ্রীতে সূক্ষ্ম চিড় ইত্যাদি দোষত্রুটির অস্তিত্ব নির্ধারণেও এক্স রশ্মি ব্যবহৃত হয়।
দেহের ভেতরে নিষিদ্ধ বস্তু বা দামী রত্ন ইত্যাদি লুকিয়ে রাখলে এক্স রশ্মির সাহায্যে তা সহজেই ধরা যায়। শুল্ক বিভাগে এবং গােয়েন্দা বিভাগে তদন্তের কাজে কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে এভাবে এক্স রশ্মি ব্যবহার হয়।
কেলাসের গঠন সংক্রান্ত পরীক্ষা, অণু এবং পরমাণুর গঠন সংক্রান্ত গবেষণায় এক্স রশ্মি ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে এক্স রশ্মি ব্যবহারের নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। মহাকাশ থেকে আসা এক্স রশ্মি সংক্রান্ত বিষয়গুলি এক্স-রে অ্যাস্ট্রোনমির বিশাল প্রাসাদ তৈরি করেছে।
মানব কল্যাণে এক্স রশ্মির ব্যবহারের নতুন নতুন ক্ষেত্র চিহ্নিত হচ্ছে। সাধ্যমত সেসব জেনে নেব আমরা।
গোবিন্দ দাস