আমরা সাঁওতালপল্লির কাছে থাকায় ডাইনি সমস্যা সম্পর্কে ছােটোবেলা থেকেই ওয়াকিবহাল। ফুলমণিকে যখন চুল কেটে হাঁসুয়ার কোপ দিয়ে মেরে ফেলা হয় তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। ওর চুল কেটে নেওয়ার পর যেভাবে ওকে কুপিয়ে মারা হয়েছিল তা দেখে শিশু মনে প্রচণ্ড কষ্ট হয়। কিন্তু কেন এমন হয় সেই বিজ্ঞান ও রাজনৈতিক চেতনা আমার ছিল না। এরপর বহু বছর চলে গেছে। শিকার উৎসব হলে ওদের পাড়ায় আমার নিমন্ত্রণ থাকলেও প্রতিবছর যাওয়ার সুযােগ হয় না।কিন্তু ফুলমণিকে ভুলতে পারি না।
সরস্বতী পুজোর রাত ৯-৩০, কল্যান আমাকে এসে খবর দিল, শম্ভু মান্ডি ওদের কারখানার একজন শ্রমিক, ওকে খবর দিয়েছে, ওদের তিনবােনকে ডাইন, সাব্যস্ত করেছে হুগলি জেলার জানগুরু।
কারণ পাশের বাড়ির পানমণি কিস্কু (বয়স-১২) দিনকে দিন শুকিয়ে যাচ্ছে শম্ভ মাণ্ডির বােনদের নজরের কারণে।তাই এই তিনবােনকে খতম করে ওদের রক্ত পানমনির কপালে লাগিয়ে দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
কল্যান আমাকে অনুরােধ করে যেহেতু ওই পাড়াতে তােমার যাতায়াত আছে, একবার কথা বলতে আপত্তি কী?আমার যে খুব ইচ্ছা ছিল তা নয়। কিন্তু ফুলমণির মৃত্যু তখনও আমাকে তাড়িত করছে। সকালবেলা উপস্থিত হলাম মঙ্গল কিস্কুর বাড়ি। মঙ্গলের বউ রাই কিস্কু পান্তাভাত গামছায় বেঁধে মাঠে কাজে যাবে বলে তৈরি হচ্ছে। এই সময়ে ওর বড়াে মেয়ে লক্ষ্মী কিস্কু (মাধ্যমিক দেবে) বেরিয়ে এসে একটা মাদুর পেতে দিল দাওয়াতে, ও আমাকে চেনে। ওর মাকে হাসপাতালের কথা বলতেই ওর মা বলল ওসব কিছু হবে না। হাসপাতাল গরিব মানুষের নয়।ওখানে গেলে ফেলে রেখে মেরে ফেলবে আমার মেয়েকে। আসলে
হাসপাতাল থেকে জানগুরুর আদেশ অনেক বড়াে।
আমি চাকদহ হাসপাতালের ভালাে ডাক্তারবাবুর নাম করি যিনি শিশু বিশেষজ্ঞ। ওর মা বলে, যা লাইন, আমার রােজ নষ্ট করে যাওয়ার সময় নেই। আমি নাছােড়। বলি যদি বিকেলে হয়। লক্ষ্মীর সাথে কথা বলে সম্মতি পাই।বিকেলে ভ্যানে করে বিছানায় শুইয়ে পানমণিকে হাসপাতালে আনা হয়। ডঃ অধিকারী দেখে বললেন এই হাসপাতালে কিছু করা সম্ভব
নয়। ওর কিডনির অবস্থা খারাপ আর সিভিয়ার ম্যালনিউট্রিশন। ওকে আর. জি. কর হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। এর মধ্যে কল্যানকে সব জানাই। ওই রাতে ও বলে, থানায় একটা ডাইরি করা উচিত।
যদি পানমণি মরে যায় তবে তােমাকে ওরা মেরে ফেলবে। আমি রাজি হচ্ছিলাম না থানায় যেতে। কিন্তু কল্যানের চাপে বাধ্য হলাম। কিন্তু কোনাে ডাইরি করব না এই শর্তে। আই. সি. ঘটনা শুনে প্রথমেই আমাকে রেগে গিয়ে বললেন, বেশি হিরাে হতে যাবেন না। তীরের ফলা পেটে ঢুকলে তা অপারেশন করে
বার করতে হবে।
সকালবেলা ভাের পাঁচটার ট্রেনে আমি লক্ষ্মী, রাই, পানমণিকে নিয়ে রওনা হলাম আর. জি. কর হাসপাতালের উদ্দেশে।আউটডােরে লাইন দিয়ে যখন দুপুর ১টার সময় ডাক্তারবাবুর কাছে পৌছালাম তখন আউটডাের বন্ধ হয়ে গিয়েছে। পানমণির মা রাই অত্যন্ত বিরক্ত- ‘আমি বলেছিলাম কিছু হবে না। মাঠের কাজটাও আজ মার খেল।’
ডিপার্টমেন্টাল হেড (চাইল্ড ইউনিট)বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। আমি কথা বলবার জন্য সামনে যেতে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললেন আমার মিটিং আছে, কথা শােনবার সময় নেই। আমি পা জড়িয়ে ধরে বললাম, আমি সহ তিনজন খুন হয়ে যাবে—বলে ড. অধিকারীর চিঠিটা ওনার হাতে দিলাম। উনি ওই চিঠি পড়ে চিঠির পিছনে লিখে দিয়ে বললেন, ডাক্তার কিস্তুর কাছে যান। ও ভর্তি নিয়ে নেবে।কিন্তু একজনকে থাকতে হবে। ডাক্তার কিস্কু ভর্তি নিয়ে নিলেন। শুরু হল যাত্রা। ওর মা রাই রােজ-এর কাজ বন্ধ করে হাসপাতালে থেকে গেল। শুরু হল অসম লড়াই। আমি আর লক্ষ্মী দুপুরে যাই আর রাতে তই ফিরি। সরকারি চিকিৎসার মধ্যে দিয়ে ও আস্তে আস্তে ভালাে হতে থাকে। আমরা প্রতীক্ষায় থাকি কবে ফিরবে পানমনি। পাড়াতে দূর হবে ডাইনির কালিমা। যেদিন পানমণি পাড়াতে ফিরল সেদিন যেন উৎসব। এতদিন মঙ্গল (লক্ষ্মীর বাবা) আমার সাথে কথা বলত না।লক্ষ্মীকে বলল, দাদাকে মিষ্টি খাওয়া। আমি বললাম, আজ বল ডাইনি বলে কিছু হয় ?
এই। ওই আদিবাসী পাড়াতে এখনও শিকার উৎসব হয়। তবে ডাইনি
না নেই। আর লক্ষী এখন বিজ্ঞানকর্মী।
বিবর্তন ভট্টাচার্য