সুদুর অতীতে, গােন্ডােয়াল্যান্ড এবং আঙ্গারাল্যান্ড নামক দুটি মহাদেশীয় ভূখণ্ডের পারস্পরিক চাপে, টেথিস সাগরের তলদেশ থেকে ধাপে ধাপে উপরে উঠে আসে নবীন ভঙ্গিল পর্বত-হিমালয়। সেই হিমালয়ের অন্যতম অলংকার-তুষারশােভিত, বিশ্বের উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ-মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা যে ৮৮৪৮ মিটার বা ২৯ হাজার ২ ফিট— সেটা পরিমাপ করেছিলেন বঙ্গদেশের অন্যতম ভূ-বিজ্ঞানী এবং নব্যবঙ্গ আন্দোলনের তরুণ বৈপ্লবিক নেতা– হেনরি ল্যুইস ভিভিয়ান ডিরােজিও-র সুযােগ্য ছাত্র-রাধানাথ সিকদার।
এরপরে, নেপালের প্রলংকর ভূমিকম্পের মতাে বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং মহাদেশীয় বা
ভূখণ্ডগুলি (Tectonic Plates) পরস্পর সরে যাওয়ার ফলে, পৃথিবীর এই সর্বোচ্চ শৈলশিখর ‘সাগরমাথা’ বা ‘পীক ফিফটিন’-এর উচ্চতা -বাড়ছে, না কমছে। সেটা নিয়ে গবেষণা শুরু করেছেন ভূবিজ্ঞানীরা।
সার্ভে অব ইণ্ডিয়া, বা ভারতের ভূবৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ থেকে জানানাে হয়েছে— মাউন্ট এভারেস্টের প্রকৃত উচ্চতার আবার মাপজোক করা হবে। মাউন্ট এভারেস্ট থেকে মাত্র ২১৫ কিমি. পশ্চিমে অবস্থিত,
নেপালের গােখা জেলার অন্তর্গত বারপাক গ্রামটিই ছিল দুই বছর আগেকার ভয়াবহ ভূকম্পনের উপকেন্দ্র (Epicenter)। প্রায় ১৫ কিমি গভীর এই উপকেন্দ্রে প্রবল ভূকম্পন, মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতার ওপর প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করছেন ভূবিজ্ঞানীরা। এই ভূআন্দোলনের ফলে ধাক্কা খেয়েছে ইউরেশিয় ভূখণ্ডটি। ফলে, মাউন্ট এভারেস্ট, উচ্চতায় কিছুটা কমেও যেতে পারে।
এই পর্বতশৃঙ্গটির পুনরায় দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করতে পারলে ভারতীয় উপমহাদেশের নীচে মহাদেশীয় ভূখণ্ডগুলির গতিবিক্ষেপ কেমন হচ্ছে সেটাও জানতে পারা যাবে। সেজন্যই ভারতের সার্ভেয়র জেনারেল এস. সুব্বারাও জানিয়েছেন মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা আবার নিরূপণ করতে হবে। এরজন্য সময় লাগবে প্রায় মাস দুয়েকের মতাে।
গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম পদ্ধতির (GPS) ও থিওডােলাইট নামক যন্ত্রের সাহায্যে এভারেস্ট শৈলশৃঙ্গের উচ্চতাকে আবার মূল্যায়ন করা হবে। আশ্চর্যের কথা প্রাচীন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ক্লদিউস তােলেমি, হিমালয়
বা হিমাদ্রি’-র কথা, তার ‘আলমাজেস্ত’ বইটির মধ্যে, ‘ইমাউস’ ও ‘ইমােদি’ শব্দদুটির (হিমাদ্রির গ্রীক অপভ্রংশ ?) মাধ্যমে জানিয়েছিলেন।
সেখানেও তিনি বলেছিলেন- এই পর্বতমালার মধ্যেই বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশিখর লুকিয়ে আছে যার ওপরে মানব বিজয় কেতন উড়িয়েছেন তেনজিং নােরগে, এডমন্ড হিলারি, জুনকো তাবেই, রাইনহােল্ড মেসনার,
বাচেন্দ্ৰী পাল-এর মতাে দুঃসাহসী পর্বতাভিযাত্রীরা।
এশিয়াটিক সােসাইটির প্রতিষ্ঠাতা এবং সুপ্রিম কোর্টের পূর্বতন বিচারপতি স্যার উইলিয়াম জোনস-ও, ১৭৮৪ সালে বারাণসী যাওয়ার পথে লিখেছিলেন মাউন্ট এভারেস্টের সঠিক উচ্চতা নিরূপণের প্রয়ােজন আছে। বিহারের ভাগলপুর থেকে চোমাে লাহরি এবং এভারেস্ট পর্বতশৃঙ্গ দুটির তুষার-গরিমা দেখে রােমাঞ্চিত হয়েছিলেন জোনস। ১৮৫৬ সালে, তদানীন্তন সার্ভেয়ার জেনারেল স্যার জর্জ এভারেস্টের সুপারিশে এই পর্বতশৃঙ্গের উচ্চতা সর্বপ্রথম মাপা হয়।
প্রমাণ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা আবার নিরূপণ করেন ১৯৫৫ সালে, সার্ভে অব ইণ্ডিয়ার ভূবিজ্ঞানী ডাঃবি. এল. গুলাটি। অবশ্য, ১৯৮৭ সালে পাকিস্তানের থেকে দাবি এসেছিল— কারাকোরাম পর্বতশৃঙ্গের অন্তর্গত গডউইন অস্টিন নামক পর্বত-চূড়াটি, মাউন্ট এভারেস্টের থেকে উঁচু।
১৯৯৯ সালে মার্কিন পর্বত অভিযাত্রী-ব্র্যাডফোর্ড ওয়াশিংটন, জি.পি.এস যন্ত্রের সাহায্যে মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা দেখান ৮৮৫০ মিটার। চূড়াটির ওপর বরফস্তরের উচ্চতা-প্রায় ১ মিটারের মতাে।
চাইনিজ আকাদেমী অব সায়েন্সেস থেকে মাউন্ট এভারেস্ট-এর উচ্চতাকে ৮,৮৪৪.৪৩ মিটার পর্যন্ত বলা হয়েছে। এখনও, মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতার তারতম্য নিয়ে জল্পনা কল্পনা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।
কৌশিক রায়