পরিষ্কার এক বােতল জল।সেই টলটলে জলের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন ভদ্রলােক। বােতলের জল
থেকে একটা নীলাভ আলাের ছটা বেরিয়ে আসছে কেন?
জলভরা বােতলটা অনেকক্ষণ তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মধ্যে রাখা ছিল। তাহলে এই নীলচে আলাে কী সেই বিকিরণেরই কারসাজি? নিজের চোখকে আরও শাণিয়ে নেওয়ার জন্য ভদ্রলােক শুরু করলেন এক কঠোর সাধনা। দিনের কাজ শুরু করার আগে একঘন্টা করে কাটাতে লাগলেন পুরােপুরি অন্ধকার একটা ঘরে।।তারপর অনবরত ওই হালকা নীল আলাের দিকে তাকিয়ে থাকা।
শেষে ১৯৩৪ সালে পুরাে ঘটনাটার বিবরণ দিয়ে লিখে ফেললেন একটা গবেষণাপত্র। ছেপে বেরনাের সাথে সাথেই হই চই শুরু হয়ে গেল এই পেপার নিয়ে। রাতারাতি সেলিব্রিটি হয়ে উঠলেন রাশিয়ান পদার্থবিদ পাভেল আলেক্সিভিচ চেরেনকভ।
১৯৩৭ সালে ওই নীলচে আলাের উৎপত্তির কারণ ব্যাখ্যা করলেন পদার্থবিদ ইলিয়া ফ্র্যাঙ্ক আর ইগর ট্যাম।
(ইলিয়া ফ্র্যাঙ্ক)
তারা দেখালেন কোনাে মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে আধানযুক্ত কোনাে কণা আলাের থেকে বেশি বেগে ছুটলেই একমাত্র এরকম নীল আলাে দেখতে পাওয়া সম্ভব। কিন্তু আমরা তাে জানি এই মহাবিশ্বে আলাের বেগই সর্বোচ্চ বেগ, প্রতি সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলােমিটার। তাহলে তার থেকে বেশি বেগে কণা ছুটবে কীভাবে? আসলে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। আলাে যখন ফাকা জায়গা দিয়ে যায় তখন তার বেগ ওই তিন লক্ষ কিলােমিটার প্রতি সেকেন্ড। কিন্তু কোনও মাধ্যমের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময়ে আলাের বেগ অনেকটাই কমে যায়। তাহলে তার থেকে বেশি বেগে কোনও কণা ছুটতেই পারে। তার মানে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ থেকে ছিটকে আসা আহিত কণা জলের মধ্যে দিয়ে ছুটে যাওয়াতেই দেখা গিয়েছিল ওই নীলাভ আলাের ছটা। চেরেনকভকে সম্মান জানিয়ে তাই এই ঘটনার নাম রাখা হল ‘চেরেনকভ এফেক্ট।
১৯৫৮ সালে চেরেনকভ পেলেন পদার্থবিদ্যার নােবেল, সঙ্গে অবশ্যই ট্যাম আর ফ্র্যাঙ্ক।।পদার্থবিদ্যার নানা ক্ষেত্রে এই চেরেনকভ এফেক্টকে কাজে লাগানাে হয়েছে। কিন্তু ক্যান্সার চিকিৎসাতেও যে একে কাজে লাগানাে সম্ভব না সেটা এতদিন আমাদের জানা ছিল না। জানালেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা নিকোলে একারম্যান। জীবদেহের ক্যান্সার আক্রান্ত কোশগুলােকে খুব তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করার একটা নতুন উপায় বের করেছেন একারম্যান আর তার সহযােগীরা। তারা এই পদ্ধতিটার নাম দিয়েছেন ‘চেরেনকভ লাইট ইমেজিং’।আসলে ক্যান্সার আক্রান্ত কোশগুলােকে চেনার জন্য দরকার পড়ে একটা উপযুক্ত অ্যান্টিবডির। চিকিৎসকের কাজ গুকোজের সঙ্গে ওই অ্যান্টিবডিকে জুড়ে দিয়ে ক্যান্সার আক্রান্ত কোশগুলােতে পৌঁছে দেওয়া। ক্যান্সার আক্রান্ত কোশ যেহেতু খুব তাড়াতাড়ি বাড়ে, তাই তাদের প্রচুর পরিমাণে গ্লুকোজের দরকার হয়। ফলে অ্যান্টিবড়ি আর গ্লুকোজের সিস্টেমটা খুব তাড়াতাড়ি ক্যান্সার আক্রান্ত কোশের ঘাড়ে চেপে বসতে পারে।
একারম্যান আর তার দলবল ফন্দি আঁটলেন”তেজস্ক্রিয় গ্লুকোজ” বানানাের। তার জন্য একটা তেজস্ক্রিয় আইসােটোপকে (অ্যাক্টিনিয়াম-২২৫) তারা গুজে দিলেন ওই গ্লকোজ অনুর ভিতরে। এই তেজস্ক্রিয় আইসােটোপের বিঘটনে যে নােভেটিভ চার্জের বিটা কণা বেরিয়ে আসে সেটা আগেই জানা ছিল। আর জীবদেহের কোশ-কলার বেশির ভাগ অঞ্চলই যে জলে ভরা সে আমাদের সবারই জানা। সুতরাং জলের মধ্যে দিয়ে নেগেটিভ চার্জের বিটা কণাগুলাে যাওয়ার সময়ে বেরিয়ে আসবে চোরেনকভের সেই নীল আলাে। ওই নীল আলােতে ক্যান্সার আক্রান্ত অঞ্চলের ছবি তুলে রাখার ব্যবস্থাও হল। অ্যান্টিবডি আর তেজস্ক্রিয় গ্লুকোজের সিস্টেমের সঙ্গে একারম্যান জুড়ে দিলেন ছােট্ট একটা ক্যামেরা, যার পােষাকি নাম ‘চার্জড় কাল্ড ডিভাইসেস’, সংক্ষেপে ‘সি সি ডি’।
পুরাে ব্যাপারটার কার্যকারিতা দেখার জন্য একারম্যান আর তার সহকর্মীরা মানুষের দেহের ক্যান্সার আক্রান্ত কিছু কোশ ঢুকিয়ে দিলেন কয়েকটা ইদুরের শরীরে। এবারে ওই তেজস্ক্রিয় গ্লুকোজকে ঢুকিয়ে
দেওয়া হল ইদুরগুলাের শরীরে। একারম্যান দেখালেন যে তিন মিনিটের মধ্যেই ইদুরের দেহে চার থেকে পাঁচটা ক্যান্সার আক্রান্ত কোশকে চেনা যাচ্ছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে আক্রান্ত কোশগুলােকে চিনে নেওয়ার এই ব্যাপারটাই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। একারম্যানের দাবি,ক্যান্সারের শিকার কোনাে রােগীর অপারেশন চলাকালীনই ডাক্তারবাবু দেখে নিতে পারবেন রােগীর শরীরের আর কোনাে ক্যান্সার কোশ
আছে কী না। কত তাড়াতাড়ি এই পদ্ধতি দুরারােগ্য ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহার করা শুরু হবে এখন শুধু তার অপেক্ষাতেই অধীর আগ্রহে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকা।।
অনিন্দ্য দে