আচ্ছা, ভাবুন তো পৃথিবী শেষ হয়ে আসছে! 2012 এর কোনো সিক্যুয়েলের চিত্রনাট্য আপনাদের শোনাচ্ছি না, সেই নোয়ার নৌকো আর মহাপ্লাবনের গল্প বলছি না ।পরিবেশ যে পরিবর্তন হয়েছে সেটা আমি আপনি সবাই বুঝতে পারছি । জলবায়ু বা আবহাওয়া তার গথ বাঁধা চিরাচরিত গন্ডি পেরিয়ে গেছে, কেবল লক্ষণ রেখা পেরোলেই সর্বনাশ। প্ৰথমেই দেখুন ঋতু, বাংলা রচনা এলে 6টি ঋতু বাংলায় দেখা যায়। আমারা সকলেই লিখব কিন্তু ঋতু বললেই এখন বছরের অধিকাংশ সময়ই গ্রীষ্ম কাল, বর্ষার কোনো নিশ্চয়তা নেই! প্রায় সারা বছরই একটু আধটু বর্ষা চলতে থাকে । সেই কালিদাসের “আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে” ও আর হয় না । দিন 15-20দিনের শীত, আর বাঙালি বলে দুর্গাপুজোর কল্যাণে দিন দশকের কল্পনার শরৎ! কখনও ভেবেছেন কেন এমন হল?
না, বিশ্বউষ্ণায়ন শব্দটির দোহাই দেবো না শুধু! দোষ কী কেবল দূষণের আর কলকারখানার! আসল দোষী যদি কেউ হয় তাহলে, মানুষের স্বাচ্ছন্দপূর্ণ আর যান্ত্রিক জীবন । আজ থেকে যদি দুই বা আড়াই দশক পিছনে ফিরে যাই, দেখব গাছ আর গাড়ির সংখ্যার কমা-বাড়া ব্যস্তানুপাতিক হারে, আমরা গাছ কাটছি, বেশি বেশি করে গাড়ি কিনছি আর দূষণ বাড়াচ্ছি ।ফলে উত্তপ্ত হচ্ছে পরিবেশ গরম থেকে রক্ষা পেতে, বাড়ি অফিস সব জায়গাতেই আবির্ভাব ঘটছে শীতাতপনিয়ন্ত্রক যন্ত্রের, রেফ্রিজারেটরের যা নির্গত করছে Co2,CFC,অর্থাৎ বিশ্বউষ্ণায়ন বাড়ছে ।
2018-2019 সালের কথা ধরি, ভারতের মহাসাগরীয় বলয় প্রায় 9 থেকে 10 টি ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোনিক স্ট্রম দেখেছে । এছাড়াও আরো কিছু ঝড় আসার সম্ভবনা তৈরি হয়েছিল কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছোয়নি। বাংলাও রক্ষা পায়নি ক্ষতির হাত থেকে…..বুলবুল,ফণি! প্রতিবছরই এ জিনিস হচ্ছে, গত দশকে যদি দেখি বাংলায় ছোটো বড়ো ঝড় নিয়ে সংখ্যাটা নেহাত কম না, পাইলিন, হুদহুদ, আয়লা; শুধু নাম করে আর তালিকা দীর্ঘায়িত করতে চাই না । এই সামগ্রিক জলবায়ু পরিবর্তন কিন্তু, কোনো সিঁদুরে মেঘ নয়! বরং এক ভয়াবহ অশনিসংকেত!
প্রতি বছর ডিসেম্বরে অক্সফোর্ড ঘোষণা করে “ওয়ার্ড অফ ডি ইয়ার”,2018 সালে যেটি ছিল টক্সিক এবং এই বছরের শব্দটি হল “ক্লাইমেট এমার্জেন্সি”, জলবায়ু পরিবর্তন যে কতটা মারাত্মক তার ইঙ্গিত সর্বত্রই পাওয়া যাচ্ছে ।
সম্প্রতি NASA তার উপগ্রহ থেকে পাওয়া চিত্রের ভিত্তিতে এক অদ্ভুত দাবি করেছে, যা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। যেভাবে পৃথিবীর মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে, তার ফলে সমুদ্রের জলস্তর বেড়ে গিয়ে প্লাবনের সম্ভবনা এখন আর অনুমান পর্যায়ে নেই; এ এক অনিবার্য ভবিষ্যৎ! গত শতাব্দীতেই বিজ্ঞানীরা এই আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন, সমুদ্রের জলস্তরের কয়েক মিলিমিটার বৃদ্ধিও লক্ষ্য করা গেছে, যা সম্ভবনাকে বাস্তব প্রমাণ করছে । শেষ দুই দশকে 10-12 মিলিমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি দেখা গেছে ।
গবেষকেরা জানিয়েছেন, সমুদ্রের জলস্তর বেড়ে গিয়ে প্লাবনের সম্ভাবনা রয়েছে পৃথিবীর পশ্চিমভাগের মহাদেশগুলিতে; বিশেষ করে স্টকহোম, সাংহাই, সিডনি, পার্থ ইত্যাদি শহরগুলির চরম বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। ভিয়েতনাম এবং ইন্দোনেশিয়ার মত দেশগুলির প্রায় সম্পূর্ণ জলের তলায় তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। ভারতের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের অনুমান অনুযায়ী ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে গুজরাট মুম্বাই এবং কলকাতায়। বিজ্ঞানীরা এই ঘটনার সময়সীমাও বেঁধে দিয়েছেন 2050 থেকে 2080 সালের মধ্যে এই সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে, অর্থাৎ আগামী 30 থেকে 50 বছরের মধ্যেই মেরু অঞ্চলের প্রায় অধিকাংশ বরফ গলে জলে পরিণত হবে ।ইতিমধ্যেই কলকাতার উপকন্ঠে নদীর দু’ধারে ম্যানগ্রোভ বা লবণাম্বু উদ্ভিদের দেখা মিলছে; স্পষ্টতই যা ইঙ্গিত করছে যে সমুদ্রের নোনা জল নদীর মধ্যে ঢুকে পড়ছে ।
বিজ্ঞানীরা বলছেন বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে, যদি আর উষ্ণতা বৃদ্ধি না পায় এবং সেই হারে যদি পুনরায় দূষণ না হয়, তাও এই বিপর্যয় রোধ করা অসম্ভব। তার প্রধান কারণ গত অর্ধশতাব্দীতে গড় উষ্ণতা ৪ ডিগ্রি থেকে ৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধি এবং পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে এবং পরিবেশে ব্যাপকহারে দূষণ এবং দূষক এর উপস্থিতি। এই বিপর্যয় রোধ করার একটি মাত্র উপায় হল আর নতুন করে দূষণ না করে বরং যে দূষণ রয়েছে, যতটা পরিমাণে, পারা যায় সেটি কম করা । বাতাসে উপস্থিত দূষণের পরিমাণ কমাতে পারলেই,পরিবেশের উষ্ণতা হ্রাস পাবে যার ফলে কিছুটা হলে রক্ষা করা যেতে পারে প্রকৃতিকে।
এমনই এক নতুন পথের সন্ধান দিয়েছেন, মেক্সিকোর Biomitech নামনামের স্টার্টআপ কোম্পানি, তারা তৈরি করছেন এয়ার পিউরিফায়ার যার নাম দিয়েছেন আর্টিফিশিয়াল ট্রি । এই কৃত্রিম গাছে 368 গাছের সমপরিমাণ দূষণ শোষণ করতে পারে । এরা উচ্চতায় 14 ফুট; একটি ল্যাম্পোস্টের মতো কিন্তু এর মাথার অংশটি অনেকটা ফানেলের মতো দেখতে যার মধ্যে রাখা হয়েছে মাইক্রোএলগি ।
এই কৃত্রিম গাছের এক একটির ওজন একটনের মতো,পার্টিকুলেট ম্যাটার প্রায় 99.7% এরা শোষণ করতে সক্ষম এবং 10টির মতো বাতাসে ভাসমান SPM কে এরা শোষণ করেছে বর্তমানে, যদিও এটি ভার্সন দ্বিতীয় । পরবর্তী সংস্করণগুলি আরও বেশি কার্য্যকরী হবে বলে আশা করা যায় । এক একটি এই গাছ 2890 জন মানুষের প্রয়োজনীয় দৈনিক বাতাসকে শুদ্ধ করতে সক্ষম । কলম্বিয়া,পানামা এবং মেক্সিকো এই তিনটি জায়গায় পরীক্ষামুলক ভাবে কৃত্রিম গাছে ব্যবহার করা হচ্ছে, প্রতিটির জন্য খরচ হচ্ছে পঞ্চাশ হাজার ডলার, সোলার প্যানেল থাকায় বিদ্যুতের কোনো প্রয়োজন পড়ছে না ।
এই রকম অভিনব কিছু প্রযুক্তি এবং তার ব্যবহার, আমাদের এই বিপর্যয়ের পরিস্থিতিকে অনেকটাই পিছু ঠেলে দিতে পারে; কালবিলম্বে আমারাও কিছু কাল সময় পেয়ে যেতে পারি !


