মেঘমুক্ত রাতের আকাশের দিকে তাকালে চোখে পড়ে লক্ষ-কোটি তারা।এরা সবাই এক একটা জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড। অথচ রাতের আকাশটা কিন্তু নিকষ কালাে। ১৬১০ সালে যােহান কেপলার এই রহস্যের সমাধানে বেশ অনেকটা এগিয়েছিলেন। ১৮ শতকে এডমন্ড হ্যালিও বিষয়টা নিয়ে গভীরভাবে ভেবেছিলেন। পরবর্তীকালে ১৮২৩ সালে এই ধাঁধার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী হাইনরিখ ওলবার্স।

আসলে জ্ঞানচর্চার একেবারে শুরু থেকেই আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে আমাদের এই মহাবিশ্ব সীমাহীন, এর জীবন অনন্ত। তার মানে,সময় এগােলেও বার্ধক্য তাকে ছুঁতে পারেনি। কিন্তু এরকম একটা মডেল ধরে এগােতে গেলেই আমরা দেখব, প্রতি সেকেন্ডে যে বিপুল পরিমাণ শক্তি আমাদের পৃথিবীতে এসে পৌঁছবে তাকে সংখ্যায় প্রকাশ করা যাবে না; সীমাহীন উষ্ণতায় দগ্ধ হবে তার সারা অঙ্গ। সেক্ষেত্রে পৃথিবীর আকাশ অসীম ঔজ্জ্বল্যে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠার কথা। অথচ রাতের আকাশে এক অদ্ভুত আঁধার। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায় এই ধাঁধার পােষাকি নাম ‘ওলবার্স প্যারাডক্স’।

১৮৪৮ সালে ‘ইউরেকা—একটি গদ্য কবিতা’ নামে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন সাহিত্যিক এডগার অ্যালান পাে। সেই প্রবন্ধের আইডিয়া অবলম্বন করে লর্ড কেলভিন ১৯০১ সালে একটা গবেষণা পত্রে লিখলেন, মহাবিশ্বে নক্ষত্রের সংখ্যা যদি অসীম হয়, তাহলে আকাশের প্রত্যেকটা বিন্দুতেই কোনাে না-কোনাে একটা নক্ষত্রকে পাওয়া যাবে।
তাহলে আকাশে বেশির ভাগ অঞ্চলটাই অন্ধকার কেন ? কেলভিন বললেন— ওই অন্ধকার অঞ্চলে যে নক্ষত্রগুলাে আছে তারা পৃথিবী থেকে এতটাই দূরে যে তাদের আলাে এখনও পর্যন্ত পৃথিবীতে এসে
পৌছতে পারেনি। আবার ঘন মেঘের দেওয়াল ভেদ করে অতিদুর নক্ষত্রলােকের আলাে পৃথিবীতে এসে পৌঁছচ্ছে না— সেরকম একটা ধারণাও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেটা ধােপে টেকে নি। কারণ সেরকম হলে নক্ষত্রের বিকিরণে ওই মেঘের চাদর নিজেই গরম হতে শুরু করত, আর তাতে নক্ষত্র থেকে ঠিক যতখানি আলাে বেরােয়, মেঘের আস্তরণ থেকে ঠিক ততখানি আলােই বেরিয়ে আসত। সুতরাং, রাতের আকাশ আলােয় আলােকময় হয়ে ওঠারই কথা ছিল।
এই তর্ক-বিতর্কের মধ্যে দিয়ে এগােতে এগােতেই ১৯১৬ সালে আমরা পেয়ে গেলাম আইনস্টাইনের জেনারেল রিলেটিভিটির তত্ত্ব। এই তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে দেখানাে গেল যে, আমাদের এই মহাবিশ্বের
বিস্তার মােটেও সীমাহীন নয়; তবে সময়ের সাথে তার সীমানাটা বেড়ে চলেছে। মহাবিশ্ব যে চিরস্থায়ী নয় জেনারেল রিলেটিভিটির তত্ত্ব সেটাও বলে দিল। সুদূর অতীতে তুমুল বিস্ফোরন, ‘বিগ ব্যাং’ থেকে এর যাত্রা শুরু। তার মানে, এই মহাবিশ্বের সবথেকে পুরনাে নক্ষত্রটা যেখানে আছে তার থেকেও দুরের কোন অঞ্চল থেকে পৃথিবীতে আলাে আসার কোন প্রশ্নই নেই। আবার মহাবিশ্ব যেহেতু ক্রমশ বেড়ে চলেছে, তাই দুটো নক্ষত্রের মাঝখানের ফাঁকা জায়গা দিয়ে বেশির ভাগ দৃষ্টিরেখাই কোন নক্ষত্রে গিয়ে পৌঁছবে না। হিসেব কষে দেখা গেছে, মহাবিশ্বের এই প্রসারণের ব্যাপারটা যদি না থাকত, আর তার বয়সটা যদি আরও একটু
কম হত, তাহলে রাতের আকাশের ঔজ্জল্য প্রায় ৫০০০ কোটি গুণ বেড়ে যেত। সুতরাং ক্রমশ প্রসারণশীল মহাবিশ্বে ঘন অন্ধকারে ভরা।রাতের আকাশ দেখা ছাড়া আমাদের আর কোনাে পথ নেই।

আলােচনাটাকে এখানেই শেষ করে দেওয়া যেত, কিন্তু তার উপায় নেই। কারণ জেনারেল রিলেটিভিটির বিশ্লেষণ যে আমাদেরকে আরাে গভীর অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে সেটাও একটু বুঝে নেওয়া দরকার।
বিগ ব্যাং-এর পরে, প্রায় ৩ লক্ষ বছর পর্যন্ত মহাবিশ্বের উষ্ণতা এতটাই বেশি ছিল যে ফোটন, ইলেকট্রন আর প্রােটন একসাথে ভেসে বেড়াতে পারত। সেই ভাসমান ইলেকট্রনের ধাক্কায় ফোটন খুব বেশিদূর এগােতে পারত না। ফলে আকাশ ভরে থাকত উজ্জ্বল আলােয়। অর্থাৎ প্রাগৈতিহাসিক যুগের আকাশ আজকের তুলনায় যে অনেকটা বেশি ঝলমলে ছিল সেটা পরিষ্কার। কিন্তু প্রসারণের সাথে সাথে উষ্ণতা
কমতে কমতে যখন ৩ হাজার ডিগ্রী সেলসিয়াসের কাছাকাছি এল, তখন থেকে শুরু হল ইলেকট্রন আর প্রােটন একজোট হয়ে হাইড্রোজেন পরমানু তৈরি প্রক্রিয়া। অর্থাৎ মুক্ত ইলেকট্রনের সংখ্যা এখন অনেক কম। তাই ফোটন এখন সহজেই অনেকটা দূরে চলে যেতে পারে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মহাবিশ্বের সীমানা। ফলে কমছে ফোটনের শক্তি, কমছে আলাে। সুতরাং, মহাবিশ্বের প্রসারণ যতদিন চলবে, রাতের আকাশ আরাে গভীর থেকে গভীরতর আঁধারে ডুবতে থাকবেই।

অনিন্দ্য দে।