সূর্য হল সৌরজগতের মূল কেন্দ্র। সূর্যকে কেন্দ্র করে তার চারপাশে অবিরাম ঘুরে চলেছে গ্রহগুলি। দিনের আকাশে যে সূর্যকে আমরা দেখি সেটিই সূর্যের সবটা নয়। এটি সূর্যের মধ্যের একটি অংশ মাত্র।সূর্যের প্রচন্ড আলাে এবং তাপের উৎস এটিই। সূর্যের দেহভরের অধিকাংশই এখানে স্তুপীকৃত। এই অংশটির নাম আলােকমন্ডল।আলােকমন্ডলের বাইরেও রয়েছে সূর্যদেহের অংশ যা সাধারণত খালি চোখে দেখা যায় না। পূর্ণ গ্রাস সূর্যগ্রহণের সময় অথবা অন্য সময়ে।বিশেষ ব্যবস্থায় সেই অংশটি দেখা যায়। আলােকমন্ডলকে ঘিরে তার চারপাশে রয়েছে আরও কয়েকটি স্তর যাদের বিস্তৃতি ছড়িয়ে পড়েছে সুদূর গ্রহান্তরে। আলােকমন্ডলকে ঘিরে থাকা সূর্যের এই অংশের সাধারণ নাম ‘সৌর বায়ুমন্ডল’।

সূর্যের উজ্জ্বল আলােকমন্ডলের ফাকে ফাকে দেখা যায় নানা আকৃতির কালাে কালাে দাগ। এদের নাম দেওয়া হয়েছে ‘সৌরকলঙ্ক’।১৬১০ সালে ইতালীয় বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি দুরবীণ-এর সাহায্যে সর্বপ্রথম লক্ষ করেন সৌরকলঙ্ক। প্রাচীন চীন দেশেও জানা গিয়েছিল সৌরকলঙ্কের কথা। সে সময় সৌরকলঙ্কের স্বরূপ নিয়ে বিদ্বজ্জনের মধ্যে তর্কযুদ্ধও কম হয়নি। সৌরপৃষ্ঠে কালাে কালাে দাগগুলিকে আবার গ্রহের তকমাও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গ্যালিলিওই প্রথম সাব্যস্ত করলেন ওগুলি সূর্যদেহের এই অংশ, নতুন কোন গ্রহ নয়। সে সময় সৌরকলঙ্ক নিয়ে বেশ সােরগােল হলেও গ্যালিলিও পরবর্তীকালে সৌরকলঙ্কের সংখ্যা যথেষ্ট কমে যাওয়ায় তা নিয়ে চর্চার অবকাশও কমে যায়। পরবর্তীকালে সৌরকলঙ্কের পুনরাবির্ভাবে তা নিয়ে আবার চর্চা শুরু হয়।

সৌরকলঙ্কগুলি নানা আকৃতির হয়ে থাকে। আবার একই কলঙ্কের আকৃতি সময়ের অবকাশে পরিবর্তিত হতেও দেখা যায়। তবে মােটামুটিভাবে সৌরকলঙ্কের আকার গােল বলেই ধরা হয়। এক একটি কলঙ্কের ব্যাস প্রায় ৫০০০০ কিলােমিটার পর্যন্তও হতে পারে।আলােকমন্ডলের তাপমাত্রা প্রায় ৫৮০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আলােকমন্ডলের অন্যান্য অংশের নিরিখে সৌরকলঙ্কের তাপমাত্রা কম বলে আলােকমন্ডলের ওই অংশগুলাে কালাে দেখায়। কলঙ্কগুলাে সাধারণত সৌরপৃষ্ঠে জোটবদ্ধ অবস্থায় দেখা যায়, তবে জোটহীন
কলঙ্কও অসম্ভব নয়। সব কলঙ্কের আয়ুষ্কালও সমান নয়। কোন কোনটির আয়ুষ্কাল মাত্র কয়েক ঘন্টা, কতকগুলাের কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহ। আবার কোন কোন কলঙ্ক তিন-চার মাস কালব্যাপীও দৃষ্ট হতে পারে।
সৌরপূষ্ঠে একটি দীর্ঘায়ু কলঙ্কের অবস্থান যদি লক্ষ করা যায় তবে দেখা যাবে সেটি ধীরে ধীরে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে সরে যাচ্ছে।আবার কিছুদিন পর সেগুলির পূর্বদিকে পুনরাবির্ভাব লক্ষ করা যায়।উত্তর-দক্ষিণ দিক বরাবর বিস্তৃত অক্ষের চারপাশে সূর্যের নিজস্ব ঘূর্ণনের জন্যই সৌরকলঙ্কের এরূপ অবস্থান পরিবর্তন।

সৌরপৃষ্ঠে কলঙ্কের সংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধি এক রহস্যময় ব্যাপার।কলঙ্কের সংখ্যা কোন কোন সময় দ্রুত বেড়ে গিয়ে একটি সর্বোচ্চ সংখ্যায় পৌঁছায়, আবার পরবর্তী সময়ে সেই সংখ্যা কমতে কমতে দেখা যায় প্রায় শূন্য। বেশ কিছুদিন সূর্য থাকে কলঙ্কমুক্ত। আবার সূর্য হতে থাকে কলঙ্কিত। দেখা গেছে, কলঙ্ক সংখ্যার সর্বাধিক বৃদ্ধি বা সর্বাধিক হ্রাস ঘটে প্রায় ১১ বছরের ব্যবধানে।
সৌরকলঙ্ক সৃষ্টির সম্ভাব্য কারণ হিসাবে সূর্যের চৌম্বক ক্ষেত্রকেই ধরা হয়। সৌরপৃষ্ঠে যেখানে কলঙ্কের সৃষ্টি হয় সেখানে চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রাবল্য মাত্রাতিরিক্ত হয়ে পরিচালন প্রবাহকে বাধা দেয়। ফলে সেই
জায়গাগুলাের তাপমাত্রা কিছুটা কমে যায়। তাই সেই জায়গাগুলাে কালাে দেখায়। এছাড়া সূর্যের নিজস্ব চৌম্বক ক্ষেত্রের অভিমুখ প্রায় ১১ বছরের ব্যবধানে পাল্টে যায়। ফলে সৌরকলঙ্কের সর্বাধিক হ্রাস-বৃদ্ধি ১১ বছরের সময় কালের চক্রে আবর্তিত হয়। সেদিক থেকে বলা যায় সৌরকলঙ্কের আবির্ভাব সূর্যের চৌম্বক ক্ষেত্রেরই ফলশ্রুতি।

রতন দেবনাথ