
সেদিন সকালে হাসপাতালের আউটডােরে পেশেন্ট দেখছি। একটি ২০-২২ বছরের ছেলেকে দুজনে দু’হাত ধরে নিয়ে এসে আমার সামনের চেয়ারে বসিয়ে দিল। স্বাস্থ্যবান যুবক। বিমর্ষ মুখ। এর কি এমন অসুবিধা হল যে ধরে আনতে হল। তবে কি দেখতে পাচ্ছে না ?কেমন একটা বিষগ্নভাব সবার মুখে। ভিতরের প্রশ্নগুলিকে বাইরে আনলাম।
–বলুন কি অসুবিধা?
—ডাক্তারবাবু ও একদম দেখতে পাচ্ছে না।
যুবকটির সঙ্গে আসা আত্মীয় বলল।
—কত দিন হল ?
—সাত দিন।
—এর আগে দেখতে অসুবিধা ছিল না?
—না ডাক্তারবাবু আগে ঠিকই দেখত।।
ওর হিস্ট্রি সিটে চোখ বােলালাম। অপটোমেটিস্ট ওর ভিশন এর জায়গায় লিখে রেখেছে N O P L অর্থাৎ No Perception of Light কে মানে চোখে আলাে বুঝতে পারছে না।
পরীক্ষা শুরু করলাম। সত্যি ও আলাে দেখতেও পারছে না।চোখের তারা দুটি আলাের উদ্দীপনায় সাড়া দিল না। তারার আলােয় সংকুচিত ও প্রসারিত হবার প্রবণতাই নেই। তারারন্ধ কিছুটা বর্ধিত অবস্থায় আছে।
বাইরের অংশে আর কিছু পেলাম না। কোন চোট আঘাতের চিহ্ন নেই। এবার ভিতরের পরীক্ষা। অপথ্যালমােসকোপ দিয়ে অপটিক নার্ভের অবস্থা পর্যবেক্ষণ। অপটিক নার্ভ চোখের প্রধান স্নায়ু যা রেটিনায় পরা আলাের সংবেদনকে ব্রেনে নিয়ে যায় স্নায়ুতন্ত্রের সাহায্যে। ফলে আমরা দেখতে পাই। নার্ভের অংশটিকে চোখের ভিতর গােলাকৃতি বা ডিম্বাকৃতি দেখায়। কেন্দ্রে হলুদ চারিদিকে লাল রঙের আভা।

যুবকটির অপটিক নার্ভের লাল আভা চলে গেছে। সাদা রঙের দিকে এগােচ্ছে। বাকি রেটিনা স্বাভাবিক। বিষের প্রতিক্রিয়া। মনে যে সন্দেহ হল তা জানবার জন্য প্রশ্ন করলাম।
-তুমি কি কিছু খেয়েছিলে?
যুবকটি মাথা নিচু করে আছে। বাকিরাও নির্বাক।
-না বললে তাে ডায়াগনসিস করতে পারব না। চিকিৎসাও সম্ভব
হবে না।
এবার একজন বলে,
-হ্যা ডাক্তারবাবুও মদ খেয়েছিল
অবাক হই না। এই বয়সে এই প্রবনতাই লক্ষ্য করছি।
—তুমি কি আগে মদ খেতে? মানে
নেশা করতে?
—না ডাক্তারবাবু আমার কোন নেশা ছিল না। বিশ্বাস করুন বন্ধুদের সঙ্গে মাঝে মধ্যে খেয়েছি। এর বেশি নয়। ডাক্তারবাবু আমাকে ভাল করে দিন। আর কখনও ওসব ছোঁব না কথা দিচ্ছি।এক নিঃশ্বাসে কথা বলে আমার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।
শেষদিকে ধরে এল ওর কণ্ঠস্বর।।
–ঠিক আছে। আগে খুলে বল সেদিনের ঘটনা।
যুবকটি বলে-সন্ধ্যাবেলা চার বন্ধু মদ খাবার প্রস্তাব দিল। আমি রাজি হচ্ছিলাম না। ওরা জোর করল। শেষে বাধ্য হলাম।

–মদ কোথায় পেলে?
—আমি জানি না ডাক্তারবাবু। একজন জোগাড় করেছিল। পাঁচটা ছােট বােতল এনেছিল। খেলাম কি রকম ঝাঝালাে লাগল। সেটা জানাতে ওরা বলে যত ঝাঝ হবে গলা জ্বলবে তত নেশা হবে। মনের সন্দেহ নিয়ে
খাচ্ছিলাম। একটু খেয়ে ওদের চোখ এড়িয়ে ফেলে দিয়েছিলাম।’
-তারপর?
–ওরা সবটা খেয়ে হাসাহাসি করছিল। কিছুক্ষণ গল্প আড্ডা দিয়ে সবাই বাড়ি ফিরলাম। চুপচাপ শুয়ে খাবার সময় উঠব ভাবলাম।কিছুক্ষণ পর পেটব্যথা শুরু হল। বমি বমি ভাব। বাথরুমে যাব।দাঁড়াতে পারছি না। ব্যালেন্স নেই। ঘরের মধ্যেই বমি করে ফেললাম।চোখে ঝাপসা দেখছিলাম। মাথা ঘুরছিল, শব্দ শুনে সবাই চলে এল।
কোন প্রশ্নের উত্তর দেবার আগেই অজ্ঞান হয়ে গেলাম। আর কিছু মনে নেই।
:max_bytes(150000):strip_icc()/drunk-man-slumped-on-table-831613772-5b36ab4bc9e77c003758cf20.jpg?w=750&ssl=1)
—আপনারা কি করলেন?
—ওর অবস্থা দেখে আমরা হতবাক। মদের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে ঘরে।বুঝতে কিছুই বাকি থাকল না। সময় নষ্ট না করে হসপিটালে ভর্তি করে দিয়েছিলাম। দুদিন ওখানে চিকিৎসার পর ডাক্তারবাবুরা ছুটি দিল।
বলল—ভাল চোখের হাসপাতাল দেখান। আমরা প্রাণে বাঁচিয়ে দিয়েছি।
—আর ওর বন্ধুদের কি অবস্থা?
–ওদের সকলকেই ভর্তি করতে হয়েছিল। একজন মারা গিয়েছে।তিনজনের অবস্থা ভাল নয়। চিকিৎসা চলছে নার্ভের সমস্যা দেখা দিয়েছে।
—ডাক্তারবাবু আমি দেখতে চাই। পড়তে চাই। আমাকে ভাল করে দিন। চোখের কোণ দিয়ে অশ্রুবিন্দু গালের উপর গড়িয়ে এল। বুঝলাম ওর চোখের দৃষ্টিক্ষমতা হারালেও আগের মতই সংবেদনশীল।
আমার ইশারায় একজন ছেলেটিকে বাইরে নিয়ে গেল। অন্যজন জানতে চাইল।
—ডাক্তারবাবু ওকি আর দেখতে পাবে না?
-বুঝতেই পারছেন কি সাংঘাতিক বিষ ওর শরীরে প্রবেশ করেছিল। সব ঠিক হয়ে গেলেও চোখের স্নায়ুর চরম ক্ষতি হয়ে গেছে। ওর দৃষ্টি কখনই স্বাভাবিক হবে না।
তােমরা ভাবছাে কি হল। মদ তাে অনেকেই খায়। সবাই কি অন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যুগ যুগ ধরে মানুষ এই নেশায় আক্রান্ত। রাজা থেকে সাধারণ মানুষ সবাই খায়। তবে ওদের কি হল?
প্রশ্নটা এখানেই। ওদের কি হয়েছিল, কি খেয়েছিল, মদ না অন্য কিছু। জানতে হলে এর বৈজ্ঞানিক দিকটা ভাবতে হবে। সাধারণত রাতে মদ খাও, মস্তি হুল্লরি নাচা গানা খানা পিনা কর ঘুমিয়ে যাও সকালে উঠেই ফ্রেস। একটু হ্যাংগওভার আবার কখনও কিছুই না। নেশা কেটে গেলে ব্যস না সব সময় ব্যস্ হয় না। ওদের মত পরিণতি হয়।

কেন?
বিষাক্ত মদ। মদের জন্য শরীরে বিষক্রিয়া।
মিথাইল এ্যালকোহল। এটাই কিলিং এজেন্ট।
এটি এক ধরনের নিউরােটক্সিন। চোখের ভিতর বিশেষ করে ভিট্রিয়াম জেলিতে অক্সিডাইজড হয়ে ফরমিক অ্যাসিড ও ফরম্যালডিহাইড তৈরি করে। এরাই অপটিক নার্ভের কোষের ক্ষতি করে। ফলে অন্ধত্বতা দেখা দেয়।
সাধারণত মদের সঙ্গে মেথিলেটেড স্পিরিট ফর্মে এই মিথাইল এ্যালকোহল মিশিয়ে দেওয়া হয়। বেশি খেলেই পরিণতি মৃত্যু। যুবকটি অল্প খাওয়ার জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও সঙ্গে রয়ে গেল বিষের ক্ষতিচিহ্ন। অন্ধত্ব।
এক রাতের আনন্দ ওর জীবনে ডেকে আনল চির অন্ধকার।
ডাঃ শিবপ্রসাদ পাল।