তোমাদের আরাম আমাদের মৃত্যু।
এমনি করে চলবে আর কত কাল?
আর কতকাল আমরা এমনি নিঃশব্দে ডাকব আয়ু-হরণকারী তিল তিল অপঘাতকে?
…….. সুকান্ত ভট্টাচার্য্য
ব্যর্থ প্রেম, মানসিক চাপ নয় ধূমপানের সাথে মানুষের যোগাযোগ অতি প্রাচীন কাল থেকেই বিদ্যমান ছিল ।ধূমপানের ইতিহাস সভ্যতার মতই প্রাচীন। প্রায় 8000 বছর আগে পৃথিবীতে তামাকের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। আর 6000 বছর আগে থেকে মধ্য আমেরিকায় তামাকের চাষ শুরু হয়। প্রথমদিকে মূলত ঔষধ হিসাবে ব্যবহার করা হত তামাক। তামাক গাছের শুকনো পাতাকে তামাক বলে। প্রাচীন কালেই ব্যবিলনীয় ও মিশরীয়দের মধ্যে ধূমপানের প্রচলন ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব 2000 অব্দে প্রাচীন মিশরীয়রা ‘কানাবিস’ নামক ধূমপানের প্রচলন করেছিল। যা ছিল, হুক্কার একটি রূপ।
খ্রিষ্টপূর্ব 1000 আব্দে মায়া সভ্যতার মানুষেরা ধূমপান এবং তামাক পাতা চিবানো শুরু করে। মায়ানরা তামাক পাতার সাথে বিভিন্ন ভেষজ গাছ এবং লতাপাতা যোগ করে অসুস্থ এবং আহতদের চিকিৎসা করত। প্রাচীন গুহাচিত্র থেকে জানা যায় মায়ান পুরোহিতরা ধূমপান করতেন। তাদের বিশ্বাস ছিল ধূমপানের মাধ্যমে আত্মাদের সাথে যোগাযোগ করা যায়। পরবর্তীতে মায়ানরা আমেরিকায় ছড়িয়ে যায় এবং সেই সাথে তামাককেও ছড়িয়ে দেয় সমগ্র আমেরিকা। বিখ্যাত নাবিক এবং আবিষ্কারক ক্রিস্টোফার কলম্বাস প্রথম তামাক গাছ দেখেন 1442 সালে, কলম্বাস যখন সান সাল্ভাদরে গিয়ে পৌঁছান তখন সেখানকার আদিবাসীরা মনে করেছিল কলম্বাস ঈশ্বর প্রেরিত স্বর্গীয় জীব। তারা কলম্বাসকে উপহার স্বরূপ কাঠের তৈরি যুদ্ধাস্ত্র, বন্য ফলমূল এবং শুকনো তামাক পাতা দিয়েছিল। অন্যান্য উপহারগুলো নিলেও কলম্বাস ধূমপান না করে তামাক পাতাগুলো ফেলে দিয়েছিলেন।
ইউরোপিয়ানদের মধ্যে প্রথম ধূমপান করে রদ্রিগো ডি যেরেয। তিনি ছিলেন স্পেনের নাগরিক। 1442 সালে রদ্রিগো ডি কিউবায় যান। পরবর্তীতে স্পেনে ফিরে গিয়ে তিনি জনসম্মুখে ধূমপান করে মানুষকে চমকে দিতেন। একজন মানুষের নাক এবং মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে এটা দেখে সাধারণ মানুষ ভড়কে যেত। অনেকেই ভাবতে শুরু করে যে রদ্রিগো ডি যেরেযের উপর শয়তান ভর করেছে। তাই রদ্রিগোকে 7 বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। 1530 সালের দিকে ইউরোপিয়ানরা ক্যরিবিয়ান অঞ্চলে বৃহৎ আকারে তামাক চাষ শুরু করে।
উৎপাদিত তামাক নিয়ে যাওয়া হতো ইউরোপে।মনাদেস নামের একজন স্প্যানিশ ডাক্তার বিশ্বাস করতেন যে ধূমপান ৩৬ ধরনের অসুখ নিরাময় করে। যেমন – দাঁতের ব্যথা, নখের প্রদাহ, জ্বর এমনকি ক্যান্সার। যদিও এটা শুধুই ছিল তার একান্ত বিশ্বাস।
1865 সালে ওয়াশিংটন ডিউক নামে আমেরিকার এক ব্যক্তি প্রথম হাতে তৈরি সিগারেট উদ্ভাবন করে। পরে 1883 সালে জেমস বনস্যাক নামে আর এক আমেরিকান সিগারেট তৈরির যন্ত্র উদ্ভাবন করে। যা থেকে দিনে প্রায় এক হাজার সিগারেট তৈরি করা যেত। মোগল চিত্রকলা অনুয়াযী ভারতীয় উপমহাদেশে ধূমপানের প্রচলন ঘটান মোগলরা । উপমহাদেশে নবাবি ঘরনার আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে উটেছিল সুগন্ধি তামাক সেবন। পরবর্তী সময় হুক্কা ও ছিলিমের সাহায্যেও ধূমপান করা হত। তামাকের সাহায্যে ধূমপানকে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দেয় ইউরোপিয়ানরা। প্রথম দিকে শুধু পুরুষরাই ধূমপান করলেও ধীরে ধীরে নারীরা ও আকৃষ্ট হয়। 1925 সালের দিকে সিগারেট প্রস্তুতকারকরা ব্যবসা বাড়ানোর জন্য নতুন ভোক্তা খুঁজতে শুরু করে। বিজ্ঞাপন ও হলিউডের সিনেমার মাধ্যমে তারা নারীদেরকে সিগারেটের প্রতি আকৃষ্ট করে। জনপ্রিয়তা বাড়ায় সাথে সাথে একটা প্রজন্ম সিগারেটে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুধের সময় সৈন্যরা এত বেশি ধূমপান করত যে যুক্তরাষ্ট্রে এবং ব্রিটেনে তামাক সংকট দেখা দিয়েছিলো। এজন্য ঐ সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট তামাককে সংরক্ষিত শস্য ঘোষণা করেন। 1947 সালে ব্রিটেন সিগারেটের উপর 43% ট্যাক্স বৃদ্ধি করে। ফলে 14% ব্রিটিশ নাগরিক ধূমপান ছেড়ে দেয়। 1950 সালের দিকে প্রথম সিগারেটের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে প্রচার শুরু হয়। ডঃ ওয়ান্ডার ও ডঃ গ্রাহাম একটি গবেষণায় দেখান যে, ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত 95% মানুষই 25 বছর বা তার বেশি সময় ধরে ধূমপানে আসক্ত। প্রথম ধূমপান আসক্তি দূর করার জন্য কক্লিনিক খোলেন স্যালফোড নামের এক ব্যাক্তি (1958 সালে)। 1964 সালে রেডিও টিভি তে সিগারেটর প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়। এছাড়া সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে সচেতনতামূলক কথা লেখা বাধ্যতামূলক করা হয়।1968 সালে লেটুস পাতা দিয়ে তৈরি এক প্রকার সিগারেটে আবিষ্কার করা হয়। কিন্তু তা জনপ্রিয়তা লাভে ব্যর্থ হয়। 1971 সালে ইউরোপ ও আমেরিকায় গণপরিবহন এবং সিনেমা হলে ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয়। এভাবেই ধীরে ধীরে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ধূমপান রোধ করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করে। আমাদের দেশেও প্রকাশ্য ধূমপান না করার জন্য আইন আছে। কিন্তু সেই আইন এখন পর্যন্ত কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ।
আপনি ধূমপায়ী খুব ভালো কথা। কিন্তু ধুমপান যে দুই রকম সক্রিয় ধূমপান এবং নিষ্ক্রিয় ধূমপান বা পরোক্ষ ধূমপান । আপনি তো ধোঁয়া ছেড়ে খালাস! কিন্তু,পাশের লোকটার কথা ভেবেছেন কখনও?ধূমপানের সময় ধোঁয়ার যে অংশ চারপাশের পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং অনৈচ্ছিকভাবে মানুষের দেহে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে প্রবেশ করে নিস্ক্রিয় ধূমপান বলে। অধূমপায়ী ব্যক্তির অন্যের ধূমপান থেকে সৃষ্ট ধোয়া নিশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করা, পরোক্ষ ধূমপানও ক্ষতিকর। গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপায়ীদের সঙ্গে বাস করে এমন অধূমপায়ী ব্যক্তিদের হার্টের অসুখ হওয়ার আশঙ্কা, যারা ধূমপায়ীদের সঙ্গে বাস করে না তদের চেয়ে অনেক বেশি। পরোক্ষ বা নিষ্ক্রিয় ধূমপানে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় শিশু-কিশোরদের। তাই শিশু বা কিশোরদের সামনে এবং পাবলিক প্লেসে কখনোই ধূমপান করা উচিত নয়। পরোক্ষ ধূমপানের কারণে হৃদরোগ, ফুসফুসের ক্যান্সার সহ শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগও দেখা দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, পরোক্ষ ধূমপান পুরুষের তুলনায় নারীর উপর বেশি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় 81,000 নারী মৃত্যুবরণ করেন। 2004 সালের আরেকটি গবেষণায় দেখা গিয়েছিল যে, পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের 40% শিশু, 33% অধূমপায়ী পুরুষ এবং 35% অধূমপায়ী নারী রয়েছেন। তাতে প্রমাণ মিলেছে যে, পরোক্ষ ধূমপানের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির স্বীকার হচ্ছেন ইউরোপ ও এশিয়ার মানুষ। পরোক্ষ ধূমপানের ফলে হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপের সম্ভবনা অনেক গুন বেড়ে যায়, 20 বছরের বেশি বয়সি দের ক্ষেত্রে ধূমপায়ী সঙ্গ 15গুন ফুসফুসের রোগের সম্ভবনা বাড়িয়ে দেয় । তাই উন্মুক্ত পরিবেশকে ধোঁয়াময় করে দেবার আগে,আর একটু ভাবুন!
