বিজ্ঞান শিক্ষার প্রাথমিক স্তরেই স্কুল পড়ুয়া ছাত্ররা বুঝতে পারে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কার্বন ডাই অক্সাইড ও অক্সিজেনের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে উদ্ভিদের ভূমিকা। সূর্যালােকের উপস্থিতিতে গাছেরা তাদের
সবুজ পাতায় থাকা ক্লোরােফিলের সহায়তায় জল ও কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে শর্করা জাতীয় খাদ্য তৈরী
করে। বিজ্ঞান বইতে এই প্রক্রিয়া সালােকসংশ্লেষ নামে পরিচিত। আরেকটু বড় হয়ে ওরা জানতে পারে সালােকসংশ্লেষের রাসায়নিক সমীকরণ; যেখানে ছয় অনু কার্বন ডাই অক্সাইডের সাথে ছয় অনু জল রাসায়নিক ভাবে যুক্ত হয়ে এক অনু গ্লুকোজ উৎপন্ন করে ও ছয় অনু অক্সিজেন মুক্ত হয়; জীবজগতের সাপেক্ষে বিষাক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসের সবচেয়ে উপযুক্ত পরিণতি। আরেকটু গভীরভাবে জানতে চাইলে আমরা দেখবাে যখন সূর্যালােক গাছের পাতায় এসে পড়ে তখন সবুজ-রঞ্জক ক্লোরােফিল উত্তেজিত হয়ে ইলেকট্রন বর্জন করে। এই বর্জিত ইলেকট্রনগুলিই প্রকৃতপক্ষে সালােকসংশ্লেষের রাসায়নিক ঘটনাপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে।।



বিজ্ঞানের উন্নতি এবং বিক্রিয়া কৌশল সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা থাকা সত্ত্বেও বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে কোন কার্যকরী বৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ নেওয়া এতদিন সম্ভব হয় নি। তবে ধৈৰ্য্য
হারাননি বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি Nature Chemistry জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে এক মূল্যবান গবেষণা প্রবন্ধ। গবেষকদলের প্রধান ইলিনয়েস বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক প্রশান্ত জৈন। সালােকসংশ্লেষে ক্লোরােফিলের গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে ওঁরা ব্যবহার করেছেন সােনা (gold)-র মতাে ইলেকট্রন সমৃদ্ধ ধাতব অনুঘটক। ওদের ব্যবহৃত গােল্ড পার্টিক্যালগুলি আকারে ১৩ থেকে ১৪ ন্যানােমিটার পর্যন্ত। আসলে আকার ও আকৃতির উপর ভিত্তি করেই বিভিন্ন কণা নির্দিষ্ট আলােকীয় ধর্ম দেখাতে পারে। অতীতে অনেক গবেষক একাধিক আলােক শােষণকারী পদার্থ ব্যবহার করেছেন। তবে সেইগুলি আলােকরাসায়নিক বিক্রিয়ায় একটি ইলেকট্রন স্থানান্তকরণের মাধ্যমে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। কিন্তু অধ্যাপক জৈন ও তার সহগবেষকরা বিক্রিয়ামাধ্যমে এমন কিছু নীতি ও অবস্থার সৃষ্টি করেছেন যে, সেই অবস্থায় ধাতব ন্যানাে-পার্টিক্যাল অনুঘটক একবারে দুটি করে ইলেকট্রন স্থানা-
ন্তকরণে সক্ষম। আর এই প্রক্রিয়া আলােক রাসায়নিক বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে এক-ইলেকট্রন স্থানান্তকরণের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকরী। তাছাড়া দুটি পরমাণুর মধ্যে কোনাে রাসায়নিক বন্ধন তৈরির জন্যও
তো দুটিই ইলেকট্রন লাগে!তবে কোনাে রাসায়নিক প্রক্রিয়ার কেবল দুটি ইলেকট্রন হলেই চলবে না, ওদের
প্রশমিত করার জন্য দুটি প্রােটনের (প্রকৃতপক্ষে দুটি ধনাত্মক আধান) যােগান থাকাও জরুরী। তা না হলে তৈরী হবে অত্যন্ত সক্রিয় মুক্তমুলক (free radical), যারা বিপরীত বিক্রিয়া ঘটাতেও পিছপা হয় না। ফলে বিপুল পরিমাণ শক্তির অপচয় ঘটবে। এমনকি অনুঘটকের কার্যক্ষমতাও বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে।
অধ্যাপক জৈন ও তার সহগবেষকরা গােল্ড ন্যানােপাটিক্যালের উপস্থিতিতে মাল্টিইলেকট্রন, মাল্টিপ্রােটন স্থানান্তকরণের নীতি অবলম্বন করেই তাদের গবেষণাগারে কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে ইথেন (দুই কার্বনযুক্ত সরলতম সম্পৃক্ত হাইড্রোকার্বন) তৈরী করতে সক্ষম হয়েছেন, যা হাইড্রোকার্বন জ্বালানী হিসাবে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে। ওঁদের আশা এভাবেই একদিন প্রােপেন এবং বিউটেনের
মতাে তিন বা চার কার্বনযুক্ত সম্পৃক্ত হাইড্রোকার্বন (যেগুলি LPG-এর প্রধান উপাদান) তৈরী হবে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর জন্য দায়ী বিষাক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড বদলে যাবে ব্যবহার উপযােগী গ্যাসীয় জ্বালানীতে।



অধ্যাপক জৈন মনে করেন হয়তাে আগামী এক দশকের মধ্যেই আরাে অনেক এগােবে গবেষণা ও প্রযুক্তিবিদ্যা। যখন বায়ুমণ্ডলের কার্বন ডাই অক্সাইডকে নিবন্ধকরণ (fixation)-এর পর তা থেকে জ্বালানী উৎপাদন, এই পুরাে প্রক্রিয়াটাই সমসাময়িক সামাজিক-অর্থনীতির সাপেক্ষেও হয়ে উঠবে গ্রহণযােগ্য। তবে একথাও ঠিক যে এই লক্ষ্যে এখনাে অনেক পথ চলা বাকি।
অমিতাভ চক্রবর্তী