কয়েক বছর আগে কলকাতার বাগবাজারে এক প্রতিবেশী বুদ্ধকে মাথায় মেরে খুন করে ফেলেছিল সাইকেল সারাইয়ের দোকানদার এক ছেলে। নিঃসন্তান এই বৃদ্ধ ছেলেটিকে সন্তানের মত স্নেহ করতেন। প্রতিদিন সকালে ওর দোকানে এসে বসতেন। সেদিনও এসেছিলেন। কিন্তু অনেক বেলা অব্দি ছেলেটির দোকানে কোন খদ্দের আসেনি। ওর মাথায় খুন চড়ে যায়। বৃদ্ধের যেহেতু কোন ছেলে পুলে হয় নি, তাই সে ধরে নেয়, সে অপয়া। আর সকালে তার মুখ দেখার জন্যই দোকান খদ্দের শূন্য।
ক্রোধ আর হতাশায় বৃদ্ধের মাথায় রডের বাড়ি মেরেই দিল।
কিংবা এই হাল আমলে গত ৩০শে নভেম্বর (২০১৮)-এর ঘটনা। বারাসতের সত্তরাের্ধ এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা ভােরে উঠে নানা বাড়ি থেকে পুজোর ফুল সংগ্রহ করতেন। এমনই এক বাড়িতে কোন সন্তানসন্ততি হয়নি। এক সময় তারা ধরে নিল ঐ শিক্ষিকাই অপয়া আর তার কুনজর পড়ার জন্যই
বাড়িতে বাচ্চা আসছে না। তার ওপর বাড়ির ফুলও বাইরে চলে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে ঐ বাড়ির দুই
মহিলা ওই দিন সকালে বৃদ্ধা ফুল তুলতে আসতেই তার উপর চড়াও হল। মাটিতে ফেলে মারধাের,
তারপর মাথার চুল কেটে নেওয়া হল। পরের দিনের সংবাদপত্রে বেরিয়েছিল খবরটি।।
পয়া-অপয়া তথা শুভ-অশুভ জাতীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধারণার কী নির্মম পরিণতি হতে পারে এমন ঘটনা থেকে তা বােঝা যায়। এমন চরম ঘটনা ঘটেছিল বলেই পরে কাগজের খবর হয়েছে। কিন্তু এই ধারণা তাে বহুজনের মধ্যে বহুভাবে আছেই। এবং তা নিছক কুসংস্কারই কারণ এইভাবে কোন বস্তু বা কোন ব্যক্তি পয়া বা অপয়া হতে পারে না, কোনাে কিছুকে বা কাউকে দেখাও শুভ বা অশুভ হতে পারে না। এক শালিক, একটি তারা বা কারাের শুধু এক চোখ দেখা শুভ নয়। ঠাট্টাচ্ছলে হলেও অনেকেই একসঙ্গে দুটো না দেখা অবধি শান্তি পায় না।

এছাড়া আছে নিঃসন্তান স্ত্রী বা স্বামী (বিশেষত তথাকথিত ‘বাঁজা’মহিলা), মাকুন্দ, নিম্নবর্ণের মানুষ (তথাকথিত উচ্চবর্ণের মানুষদের কাছে)- এই ভাবে মানুষজনকেও অপয়া ভাবা হয়। তাই সারাদিনের
কোনাে দুর্ভোগে ‘আজ সকালে কার মুখ দেখে উঠেছিলাম কে জানে জাতীয় কথা অনেকের মুখেই শােনা যায়। ধেনুর্বৎস প্রযুক্তা বৃষগজতুরগা : দক্ষিণাবর্তা বহ্নি’ জাতীয় সুন্দর ও প্রাচীন সংস্কৃত শ্লোকও আছে, যার অর্থ বাছুর-সহ গাভি, ষাঁড়, হাতি, ঘােড়া ইত্যাদিকে শুভ বলা হয়েছে। অর্থাৎ শুভ-অশুভ পয়া-অপয়া ব্যাপারটিকে শক্তিশালী করা। পাশাপাশি আছে বিশেষ কোন দিনক্ষণকেও শুভ-তাশুভ ভাবা ‘মঙ্গলের ঊষা বুধে পা যেথায় যাবি সেথায় যা থেকে শুরু করে বারবেলা জাতীয় নানা হাবিজাবি কথাবার্তা চালু।
কিন্তু এটি স্পষ্টভাবে জানা দরকার যে, এইভাবে কোনাে বিশেষ ব্যক্তিকে অপয়া বা অশুভ বলে চিহ্নিত করা চরম একটি অমানবিক কাজ। কাউকে অপয়া ভেবে তার শারীরিক নিগ্রহ করা আইনের চোখে
শাস্তিযােগ্য অপরাধ অবশ্যই। কিন্তু নিছক কাউকে অপয়া ভাবাটাকেই আইনত শাস্তিযােগ্য একটি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা উচিত। আর পৃথিবী নিজের মতাে ঘুরছে, দিনরাত্রি হচ্ছে। তার একটি বিশেষ
সময়টি শুভ বা অশুভ হয়ে যাবে এমন চিন্তাটাই তলিয়ে ভাবলে হাস্যকর বলে মনে হয়। আর চোখ, শালিক, তারা ইত্যাদি দেখা না-দেখাকে শুভ-অশুভ ভাবাটা তাে আরাে হাস্যকর।
কিন্তু মনের মধ্যে পয়া-অপয়া শুভ-অশুভ জাতীয় বিশ্বাস যদি থাকে তবে বিশেষ ক্ষেত্রে তা বাগবাজার বা বারাসতের মতাে চরম রূপ নিতে পারে। এই ধরনের শারীরিক-মানসিক নিগ্রহ বহু পরিবারে আর সমাজে কিন্তু নিরন্তর এখনাে ঘটে চলেছে।

ভবানী প্রসাদ সাহু