‘ছাতা’ বললেই মনে পড়ে বৃষ্টিতে মাথায় ছাতা ধরার কথা। ছাতা ধরে বাসি রুটি, পচা কাঠেও। এরকমই একধরণের পচা কাঠে ধরা ছাতা থেকে পাওয়া গেল তেলের কণা।দক্ষিণ আমেরিকায় পাটাগােনিয়া নামে একটা জায়গা আছে।সেখানকার গভীর জঙ্গলে আলমাে নামে এক রকম বড় গাছের ভেতরে দেখা যায় ঐ বিশেষ ছাতা, ছাতার নাম গ্লায়ােক্লাডিয়াম রােসিয়াম।সরু সুতাের মতাে এদের আকৃতি, ছড়িয়ে যায় খুব তাড়াতাড়ি। দিন সাতেকের মধ্যেই আক্রান্ত অংশ পুরােটা ঢেকে যায় তুলাের মতাে ছাতায়। এই তুলাের মতাে ছাতাগুলাের রঙ প্রথম দিকে থাকে সাদা বা হালকা ক্রীমের মতাে, তারপর ধীরে ধীরে রঙ পাল্টাতে থাকে ক্রমশঃ গােলাপী সবশেষে ঘন সবুজ।
মনটানা স্টেট ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা ঐ অঞ্চলে আলমে গাছের ওপরেই মাসকোডর অ্যালবাস নামে অন্য এক ছাতা নিয়ে পরীক্ষা করছিলেন। এই ছাতা থেকে বেশ কয়েকটা যৌগ পাওয়া যায়, এগুলাে নিজেরাই ধীরে ধীরে গ্যাস হয়ে উবে যায় ঠিক কপূরের মতাে। এদের বলে উদ্বায়ী যৌগ। এরা মানুষের ও গাছপালার ক্ষতিকর বই কৃমি,ছত্রাক ও পােকামাকড় নষ্ট করে। মাসকোডর অ্যালবাস নামে এই ছাতাগুলােও গাছের ভেতরে তন্তুজাতীয় অংশে বা কাঠের ওপর অন্তঃপরজীবী হিসাবে জন্মায়। বিজ্ঞানীরা অন্যান্য ছাতার ওপর ঐ উদ্বায়ী গ্যাসগুলাে কি ধরনের কাজ করে সেটাই দেখছিলেন। সেইসময় তারা দেখলেন ওইসব উদ্বায়ী গ্যাসের প্রভাবে যখন প্রায় সমস্ত ছাতা মরে যাচ্ছে তখনও ওখানে বেঁচে ছিল আর বেড়ে চলেছিল গ্লায়ােক্লাডিয়াম রােসিয়াম। এটা দেখে অবাক হয়ে গেলেন বিজ্ঞানীরা।তারা পরীক্ষা শুরু করলেন এই ছাতা নিয়ে।

এই ছাতাও উদ্বায়ী গ্যাসীয় অ্যান্টিবায়ােটিক তৈরি করে। মনটানা স্টেট ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী গ্যারী স্ট্রোবেলের ভাষায় এই পরীক্ষার ফল গায়ের রােম খাড়া হয়ে যাওয়ার মতাে। তারা গবেষণাগারে গ্লায়ােক্লাডিয়াম তৈরি করে দেখলেন এতে আছে প্রচুর হাইড্রোকার্বণ আর হাইড্রোকার্বণজাত যৌগের অণু। এর থেকে যে তেল তৈরি হল তা’ গাড়ি চালানাের ডিজেলের মতােই। জৈব জ্বালানী তৈরিতে গ্লায়ােক্লাডিয়াম সাহায্য করতে পারে বিশেষ ভাবেই।গাছের সেলুলােজ, হেমিসেলুলােজ ইত্যাদি হল আঁশ জাতীয় আর লিগনিন হল আঠার মতাে, যার সাহায্যে গাছের আঁশগুলাে একে অন্যের সাথে আটকে গাছকে সােজা রাখতে সাহায্য করে। এই জিনিসগুলাে প্রাণীরা হজম করতে পারে না, এগুলাে উদ্ভিজ্জ বর্জ্য হিসাবে জমা হয়। জৈব-জ্বালানী তৈরির জন্য এইসব বর্জ্য পদার্থ সেলুলােজ এনজাইম দিয়ে শর্করায় রূপান্তরিত করা হয়। তারপর বিভিন্ন অণুজীব এই শর্করাকে ইথানলে পরিণত করে। এই ইথানল জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। গ্লায়ােক্লাডিয়াম রােসিয়াম সেলুলােজকে সরাসরি ভেঙ্গে মাইকোডিজেল তৈরি করে। ছাতা নিয়ে পড়াশােনাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে মাইকোলজি। তাই ছাতা থেকে পাওয়া তেলের নাম দেওয়া হয়েছে মাইকোডিজেল। এই আবিষ্কারের ফলে আর একটা ঘটনাও নতুনভাবে ভাবার সময় এসেছে। আমরা জানি অতি প্রাচীনকালের গাছ ও প্রাণীর মৃত দেহাবশেষ কোটি কোটি বছর ধরে নির্দিষ্ট চাপ ও তাপের ফলে জীবাশ্ম জ্বালানীতে পরিণত হয়। গ্লায়ােক্লাডিয়াম ছাতাগুলাে যখন মাইকোডিজেল তৈরি করতে পারে, তখন ভাবতে বাধা নেই যে জীবাশ্ম তেল তৈরিতেও এই ছাতাগুলােরও একটা ভূমিকা থাকতে পারে।
গবেষণাগারে পাওয়া ছাতার তেলকে যদি বেশি করে তৈরি করা যায় তবে ভবিষ্যতে একদিন হয়তাে ছাতার তেলে গাড়িও চলবে।ব্যাপারটা বেশ অবাক করার মতাে তাই না!

জয়শ্রী দত্ত