বিজ্ঞানীরা একটা দল বা পরিবারের প্রাণীদের বলেন pri-mate; বাংলায় আমরা বলি বনমানুষ। যদিও এই দলে মানুষও পড়ে, তবে বনমানুষ বলতেই আমাদের মনে ভেসে ওঠে দশাসই, গাছে গাছে ঘুরে বেড়ানাে ভয়ংকর একদল প্রাণী।
কথাটা ঠিক নয়। এই দলে যেমন দশাসই গােরিলা আছে, আছে ছােট্ট টোম্যাটো বা ডিমের মাপের (ওজন ৫৫ গ্রামের মত) ইঁদুর লেমুর’ (mouse lemur)। আর সুমাে কুস্তিবিদদের মানুষদের সঙ্গে তুলনা করলে, সেই মানুষদের ওজন তাে গােরিলাদের চেয়েও বেশি। পৃথিবীতে চারশাের ওপর প্রজাতির বনমানুষ খুঁজে পাওয়া গেছে, গত বছরই পাওয়া গেছে আরাে একটি প্রজাতি। খোঁজা এখনাে চলছে।
এই গােত্রের প্রাণীদের ছটি শারীরিক বৈশিষ্ট্য আছে ?
১) এদের দুটো চোখই (মুখে চোখের মণির অবস্থান সামনের দিকে) একই জিনিস দুচোখে একসঙ্গে
দেখে, তাই বস্তুর তিনমাত্রার অবস্থানটা পরিষ্কার বুঝতে পারে, যদিও মাথা না ঘুরিয়ে পেছনদিকে
দেখতে পায় না।
২) চোখদুটো বসে আছে শক্তপােক্ত আংটির মত হাড়ের কাঠামাের নিরাপত্তায়।।
৩) বুড়ােআঙুল আছে ফলে এরা কোনকিছু ভালােভাবে মুঠোয় ধরতে পারে।।
৪) প্রত্যেকটা আঙুলের ডগাকে আঘাত থেকে বাঁচানাের জন্যে নখ আছে।
৫) এদের হাত বা পায়ের পাতায় লােম নেই এবং প্রত্যেক বনমানুষের নিজের আঙুলের ছাপ আছে, যেটা একান্ত সেই বনমানুষেরই।।
৬) অন্য স্তন্যপায়ীদের তুলনায় এদের মস্তিষ্ক অনেকটাই বড়, যার ফলে এরা কোন আচরণ দেখে শিখতে আর সেই আচরণ নিজে করে দেখাতে পারে (ভেঙচি কাটতেও পারে)। অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের তুলনায় অনেক বুদ্ধি ও দুষ্টুবুদ্ধি ধরে বেশি।
জন্মের পর থেকে বনমানব বড় হয় একটা সংগঠিত সামাজিক পরিবেশের মধ্যে প্রায় আমাদেরই মত
• প্রথমে শিশু বনমানব থাকে তার মায়ের কোলে (এই সময়টায় তারা পুরােপুরি মায়ের দুলাল)।
• পরের দশা বালক বনমানব, তারা বেশিটা সময় খেলা, বড়দের নকল করা, কি খাবে, কোথা থেকে খাবার জোগাড় করবে,দলের কোন বড়াের সঙ্গে কি রকম আচরণ করবে, তাদের সমাজের রীতিনিয়ম শিখতে থাকা।
•তৃতীয় বা কৈশােরে তাদের যৌন চেতনা জাগে, সম্পর্ক তৈরি হয় (প্রেমে হাবুডুবু খাবার বয়েস)।
•পরের দশায় আসে সংসার (মাতৃত্ব বা পিতৃত্বের দায়িত্ব)।
• পঞ্চম দশায় তারা অভিজ্ঞ সন্তানপালক, বিভিন্ন বয়সের সন্তান সামলাতে অভ্যস্ত, মানিয়ে চলতে পারে তার নিজের সামাজিক অবস্থান (গােষ্ঠীর নেতা বা অন্য ক্ষমতাবানদের)।
• ক্রমে হয়ে ওঠে নিজের সমাজের ঠাকুমা বা ঠাকুর্দা, বিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব—যে সমাজের প্রবীনত্ব বা নেতৃত্ব রক্ষা করে নিজেদের মধ্যে খুচরাে বিবাদ মেটায়।
• বনমানুষদের শেষটা সাধারণত হয় কোন শিকারী প্রাণীর আক্রমণে, অশক্ত শরীরকে যে অন্তিম নিষ্কৃতি দেয়।
মানব (hominid) পরিবারের শরীর আর জীবনযাত্রা দেখে, আমি তাে জীবনের শেষ অংশটা ছাড়া আমাদের সঙ্গে বিশেষ ফারাক দেখতে পাচ্ছি না। একটাই তফাৎ, আমাদের অন্তিম নিষ্কৃতি এখন হয়
হাসপাতালে। বন থেকে আমরা বেরিয়ে এসেছি মােটে দশ হাজার বছরের কিছু আগে পরে, তৈরি করেছি কংক্রিটের জঙ্গল। ওরা মানবজীবনের মূল সুরটা ধরে রেখে থেকে গেছে সবুজের মধ্যে প্রায় পঞ্চান্ন/ষাট নিযুত (সাড়ে পাঁচ থেকে ছ কোটি) বছর ধরে। মানুষ নামের প্রজাতি পৃথিবীতে এসেছে মেরেকেটে মাত্র নব্বই হাজার বছর আগে। আমরা মানব সভ্যতার উন্নতির (?) শেষ একশাে বছরে নিজেদের আর আরাে অন্য অনেক প্রাণীর জীবন বিপন্ন করে ফেলেছি।বিগত পাঁচ থেকে ছয় কোটি বছরে ওরা প্রকৃতির কোন ক্ষতিই করেনি।নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে প্রকৃতির সঙ্গে।
আধুনিক গবেষণা বলছে, ওরা হাসে, শােক পালন করে, উদাস হয়, অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে, নতুন কিছু শিখতে পারে, এমনকি শেখালে মানুষের ভাষাও বুঝতে পারে। শেখালে মানুষের সঙ্গে ইঙ্গিতে (আমেরিকান সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ; কোকো নামের এক গােরিলা,আমেরিকায় প্রায় ৩০০ শব্দ ইঙ্গিতে বলতে পারত) কথাও বলতে পারে। প্রকৃতিতে নিজেদের ভেতর ভাবের আদান-প্রদান করতে পারে।
এদের বনমানুষ বলে দূরে সরিয়ে রাখতে আমার বাধে। আমরা নিজেদের নাম দিয়েছি হােমাে সেপিয়েন্স বা বুদ্ধিমান প্রাণী, যারা উন্নয়নের নামে বিজ্ঞানের ব্যবহারের শক্তিতে বলবান হয়ে মাত্র একশাে বছরে পৃথিবীর পরিবেশ বিষাক্ত করে তুলেছে, তারা বুদ্ধিমান, না যে মানুষগুলাে প্রকৃতিতে মিশে নিজেদের জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে তারা বুদ্ধিমান!
আপনি কি বলেন?
তপন কুমার গঙ্গোপাধ্যায়।