‘চকচক করলেই সােনা হয় না বলে একটা প্রবাদ আছে। কথাটা খুবই খাটি। ধরা যাক একজন অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় ব্যক্তি গাঁয়েগঞ্জে গেছেন। রাত্রে প্রকৃতির সঙ্গে আলাপ–পরিচয়ে টর্চ হাতে ঘরছেন। হঠাৎ চকচকে এক জোড়া জিনিস চোখে পড়ল বনের মধ্যে। এগিয়ে কুড়ােতে গেলেন। নেই, অথবা আছে,থাবার আঁচড়।
রাত্তির বেলা চোরের মতােই বহু জন্তুজানােয়ার ঘােরে শিকারের আশায়। মানুষ টর্চ জ্বালাতে পারে, তারা পারে না । কবি জানিয়েছিলেন, চোখের আলােয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে’। নিশাচর প্রাণীরা কবি না হলেও চোখ জ্বেলেই কাজ সারে। কিন্তু চোখের মধ্যে তাে আর তাদের দেশলাই, লাইটার, চকমকি পাথর নেই যে ফস করে জ্বেলে নেবে! তবে রহস্যটা কী? ওদের চোখ যে সত্যি জ্বলজ্বল করে এটা নেশা না-করা লােকও প্রত্যক্ষ করতে পারে।
আসলে তাদের চোখের ভেতর আলাে তৈরি হয় না ঠিকই; তারা বাইরের আলাে প্রতিফলিত করে, আয়নার মতাে। রাতে বনে-জঙ্গলে ঘুরলে নানা রঙের জ্বলজ্বলে চোখ নজরে পড়তে পারে। সুকুমার রায় গোঁফ দিয়ে যায় চেনা’ বলে জানিয়ে গেছেন, কিন্তু রাতে চোখ দিয়েও অনেক কিছু চেনা যায়। যেমন বিন্দু
আকৃতির টোপাজের মতাে জ্বলজ্বলে জিনিস বলে দেয় এর পিছনে আছে মাকড়সা।সবুজ আলাে ঠিকরােলে বুঝতে হবে এর মালিক সেয়ানা শেয়াল। যদি রক্তচক্ষ নজরে পড়ে তাে চোখবুজে বলা যেতে পারে সেটা সিংহ-ঠকানাে খরগােশ।
এইরকম আলাে যদি চোরেদের চোখ থেকে ঠিকরােত তাহলে আর আলাে জ্বেলে চোর ধরতে হতাে না।
রাতে-চরা জন্তুদের পেটের তাগিদে ঘুরতে হয়। শিকার-খোঁজা আলাে বলতে চাঁদের আলাে বা তারাদের আলাে। চাঁদের হাসি তাে আর রােজ বাঁধ ভাঙে না!সুতরাং কতটুকু তাদের শিকার খোঁজার জন্য মেলে সেটা সহজেই অনুমেয়। কোনাে ডাকসাইটে পেটুককে যদি তিনদিন না খাইয়ে রেখে একটা রসগােল্লা দেওয়া হয়,সে সেটা তাে খাবেই, উপরন্তু পাতে পড়ে-থাকা রস এমন চাটবে যে পাতের পুরুত্বও কমে যাবে। নিশাচর প্রাণীদের অবস্থা প্রায় সে রকমই। যেটুকু আলাে পায় হাঘরের মতাে সবটুকুই চোখে ধরতে চায়। এদের চোখে রেটিনার পেছনে রঙের কণার ঘন আস্তরণের পরিবর্তে থাকে আলাে প্রতিফলন করার চকচকে আয়না । আলাে এদের চোখে পড়ে প্রতিফলিত হয়। এই প্রতিফলিত আলাের উজ্জলতা অনেক গুণ বেড়ে যায়, যা দিয়ে ওরা সহজেই অন্ধকারে অন্য বস্তুকে চিহ্নিত করতে পারে। বড় বড় রাস্তার ধারে নানা সঙ্কেত থাকে, যেগুলাের ওপর গাড়ির আলাে পড়লে দূর থেকে মনে হয় উজ্জ্বল আলাে জ্বলছে। কাছে এলে বােঝা যায় আলাে নয়, রােডসাইড রিফ্লেক্টর্স।।
টোটাল ডার্কনেসে, যাকে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার বলে, বেড়ালের পক্ষেও দর্শনলাভ সম্ভব নয়। তবে প্রায়-অন্ধকারে তারা মানুষের চেয়ে অনেক ভাল দেখতে পায়। দেখার ক্ষেত্রে অবশ্য চোখের ‘রড কোষ’ আর কোন কোষ’-এর একটা ভূমিকা আছে।
নিশাচরেরা তাে রাতে চোখের ভেতরের প্রতিফলককে কাজে লাগিয়ে আলাের তীব্রতা বাড়ায়। দিনের বেলা সূর্যের আলােয় যদি সেটা করে, তাহলে তাে চোখে অংকার দেখার কথা।
হ্যাঁ, রাতের কেরামতি দিনে দেখালে চলে না। এদের চোখে চেরা পর্দা (স্লিট পিউপিলস) আছে। কড়া রােদে এরা সেই ঝাঁপ ফেলে দিয়ে প্রয়ােজনীয় আলােকাংশটুকু মাত্র ঢুকতে দেয়। ব্যস, তাতেই কাম ফতে। মিষ্টির দোকানের উনুনেও এইভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
এতসব দেখাদেখির প্রশ্নে চলে আসে খরগােশের কথা। খরগােশ নাকি পিছনের জিনিসও দেখতে পায়! খরগােশ-শিকারীদের খালি হাতে ফেরত আসার জন্য দায়ী নাকি খরগােশের এই পিছু-দর্শন। কথাটা অনেকটাই সত্যি। ফিস-আই নামে এক ধরনের লেন্স আছে। এটা মাছের চোখের মতাে। এই লেন্স ক্যামেরায় লাগালে ফটোগ্রাফারের পেছনের অনেক দৃশ্যও ছবিতে চলে আসে। পত্রপত্রিকায় কোনাে
স্টেডিয়ামের গোলাকার ছবি দেখলে বুঝতে হবে এটি মৎসচক্ষু লেন্সের কীর্তি। ওই লেন্স ১৮০ ডিগ্রির বেশি অঞ্চলকেও ধরতে পারে।
খরগােশের চোখটাও অনেকটা সে রকম। ওদের চােখের মণিটা এত বেশি ভাল (কনভেম) যে, প্রায় বৃত্তাকার চৌহদ্দিই ওদের চোখে ধরা পড়ে। স্কুলকলেজে পরীক্ষার হলে কিছু মাস্টারমশই আছেন বা থাকেন, যাঁরা পিছনে কে টুকলি করছে দেখতে পান এবং খপ করে ধরেন । তবে তাদের উত্তাল চোখ কতটা উত্তাল তা বলা দুস্কর এবং তা নির্ণয়ের চেষ্টা ছাত্রদের কর্ণযুগলের পক্ষে বিপজ্জনকও বটে।
সমীরকুমার ঘোষ