কোনও বস্তুর পরমাণুর মধ্যে থাকা তিনটি কণিকাকেই আমরা সবচেয়ে ভালােভাবে চিনে থাকি পদার্থ বিজ্ঞানের মাধ্যমে। এরা প্রােটন,ইলেকট্রন ও নিউট্রন। তবে, বিশ্বের এই বিশাল বস্তুজগতে এই তিনটি
কণা ছাড়াও ফোটন, ট্যাকিওন, পজিট্রন, মেসন (জাপানী বিজ্ঞানী-হিদেকি ইউকাওয়ার দ্বারা আবিস্কৃত) এবং বােসন (ডাঃ সত্যেন্দ্রনাথ বােস-এর নামে নামাঙ্কিত)-এর মতাে আরাে বেশ কয়েকটি, অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণিকা(Sub-Atomic Particles) আবিষ্কৃত হয়েছে। তবে, এদের মধ্যে একটি বস্তুকণিকা সত্যিই অপার্থিব এবং রহস্যময়। কণিকাটির নাম হলাে নিউট্রিনাে। এই খামখেয়ালি বস্তুকণিকাটির সুলুকসন্ধান শুরু করেছেন পদার্থবিজ্ঞানীরা—পাহাড়ের কোলে একটি নিভৃত স্থানে।
১৯৯১ সালে সােভিয়েত গণরাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে জর্জিয়া নামক রাষ্ট্রটি। এই রাষ্ট্রটির রাজধানী শহর—বিলিসি এবং অন্য দুটি নগরী—কুতাইসি ও বাতুমি, স্থাপত্যশৈলী, ভাস্কর্য এবং
ক্রীড়াঐতিহ্যে অতি উন্নত। তাদের পাশে ককেশাস পর্বতের বরফে ঢাকা নির্জনতার মধ্যে অবস্থিত একটি ছােট্ট শহর—নিয়াইত্রিনাে-র গুরুত্ব অনেকটাই কম। তবুও চিকিৎসাবিদ্যার জনক—হিপ্পোক্রেতুস-এর
জন্মস্থান রূপে গ্রীসের ছােট্ট দীপকস যেমন বিশ্বখ্যাত হয়েছিলাে,অনুবীক্ষণ যন্ত্রের উদ্ভাবক—অ্যান্টনি ভ্যান লিউয়েন হৌক-এর জন্মস্থল হিসেবে বিজ্ঞানের মানচিত্রে যেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলাে হল্যান্ডের
ডেলফট নামক গণ্ডগ্রামটি—তেমনি নিউট্রিনাে কণিকা সম্পর্কে গবেষণার একমাত্র কেন্দ্ররূপে বিশ্বের পদার্থ বিজ্ঞানীদের কাছে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে জর্জিয়ার এই নিয়াইত্রিনাে শহরটি। আসলে, নিউট্রিনাে কণিকার নাম থেকেই এই শহরটির নতুন নামকরণ হয়েছে। নিয়াইত্রিনাে শহরে,ককেশাস পর্বতের মধ্যে প্রায় দুই মাইলের মতাে সুড়ঙ্গ কেটে, প্রায় ১২০০০ ফিট গভীরে বানানাে হয়েছে বাকসান নিউট্রিনাে অবজারভেটরি নামক গবেষণাগারটি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিশ্বের সৃষ্টির সময়ে সর্বপ্রথম বস্তুকণাকে আবিষ্কার করতে, ফ্রান্স এবং সুইৎজারল্যান্ডের সীমান্তে,আল্পস পর্বতমালার কোলে, ভূগর্ভে, “সার্ন (CERN) নামক গবেষণাকেন্দ্রে “লার্জ হ্যাড্রন কোলাইজার” নামক এরকমই একটি যন্ত্র বসানাে হয়েছে। জর্জিয়ার এই গবেষণাগারে, বহু লক্ষ্য বছর আগে মহাবিশ্বের বিভিন্ন কোণে ঘটে যাওয়া উত্তপ্ত গ্যাসীয় পিণ্ডদের
মহাবিস্ফোরণ, জ্যোতিষ্কের জন্মমৃত্যু, বিভিন্ন জ্যোতিষ্কের মধ্য থেকে তরঙ্গাকারে বেরিয়ে আসা তাপ-আলােকশক্তি প্রবাহের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অসংখ্য নিউট্রিনাে কণিকাকে খুঁজে বের করে বিশ্লেষণ করার
চেষ্টা চালাচ্ছেন মহাকাশ এবং পদার্থবিজ্ঞানীরা। তারা জানিয়েছেন-নিউট্রিনাে একটি রহস্যময় বস্তুকণিকা।



এই কণিকাটি কিন্তু তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ দ্বারা মােটেই প্রভাবিত হয় না। পাথরের স্তর এবং আমাদের
দেহ-র মধ্য দিয়েও অনায়াসে চলাচল করতে পারে এই অদৃশ্য নিউট্রিনাে কণিকা। জানা গেছে একটি ইলেকট্রন কণিকার 1/1000000 ভাগ ওজন এই নিউট্রিনাে কণিকার।।
বাকসান গবেষণাগারে বিশাল পিপের মধ্যে রাখা আছে প্রায় ৬০ টনের মতাে তরল গ্যালিয়াম ধাতু। এই ধাতুর মাধ্যমে সূর্যের কেন্দ্রস্থলে।যে তাপীয় আণবিক বিক্রিয়া অনবরত ঘটছে—তার থেকে পৃথিবীপৃষ্ঠে আগত নিউট্রিনাে বস্তুকণিকাগুলিকে বিশ্লেষণ করা সম্ভবপর হচ্ছে।
মার্কিন দেশের পদার্থবিজ্ঞানীরাও সাহায্য করে চলেছেন নিউট্রিনাে কণিকাকে খাঁচায় বন্দী করার এই অভিযানে। এইজন্য এই পরীক্ষাকে বলা হচ্ছে সােভিয়েত আমেরিক্যান গ্যালিয়া এক্সপেরিমেন্ট (SAGE)।
তবে ভূগর্ভের এই গবেষণা থেকে মহামূল্য গ্যালিয়াস ধাতু চুরি হতে পারে—এই আশঙ্কাতে ভুগছেন বিজ্ঞানীরা। বাজারে এক কিলােগ্রাম গ্যালিয়াস ধাতুর দাম প্রায় ৫০০ মার্কিন ডলার। গঠন অনুযায়ী
নিউট্রিনাে কণিকাটি আবার তিন প্রকার। ইলেকট্রোনাে, মওন এবং তাউ নিউট্রিনাে। এই তিন ধরনের নিউট্রিনাে কণিকা, নিজেদের রূপ পাল্টাতে পারে বর্ণচোরা গিরগিটির মতাে। যেমন—ইলেকট্রোনাে,
নিউট্রিনাে, নিজের গঠনের অদল বদল ঘটিয়ে মওন নিউট্রিনাে-তে পরিণত হতে পারে। আবার, চতুর্থ ধরনের নিউট্রিনাে কণিকার-ও খােজ মিলেছে বাকসান পরীক্ষা কেন্দ্রে। সেটি হলাে নিরপেক্ষ, বা “স্টেরাইল
(Sterile) নিউট্রিনাে, সবচেয়ে হালকা পাতলা বস্তুকণিকা হলেও নিউট্রিনাে—এই মহাবিশ্বে ইলেকট্রন ও প্রােটন কণিকাদের থেকেও সংখ্যায় অনেক বেশি। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলছেন—মহাবিশ্বে যতগুলি জ্যোতিষ্ক আছে, তাদের মােট ভরের সমতুল্য হলাে মহাবিশ্বের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা লক্ষ কোটি নিউট্রিনাে কণিকার সংখ্যা। সম্প্রতি নিউট্রিনাে কণিকাকে নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে মেরুপ্রদেশে, মাবিল
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ডাকোটার হােমস্টেক স্বর্ণখণিতে, জাপানে ইকেনােপর্বত এবং ইতালির গ্রাণ সাসাে পর্বতাঞ্চলে।



কৌশিক রায়