জলের স্তন্যপায়ী যার জাতীয় জলজ প্রাণীর মর্যাদা মিলেছে। গঙ্গায় গেলেই দেখা মিলত, জলের মধ্যে থেকে হঠাৎ সশব্দে উঠেই আবার ডুব! এই দৃশ্য চলত এবং বার কয়েক দেখাও যেত, কিন্তু হয়ত আসতে আসতে বিরল থেকে বিরলতর হয়ে যাওয়া এহেন প্রাণী এখন বিপন্ন। সংখ্যাতত্বের বিচারে ধুঁকছে শুশুক(গাঙ্গেয় ডলফিন) জল দূষণ, জেলের জাল, নদীর বাঁধ ও মানুষের অত্যাচার— এই চতুর্মুখী আক্রমণে নিরীহ প্রাণীগুলো লুপ্ত হওয়ার পথে। শুশুক বাঁচাতে বহুদিন ধরে আন্দোলন করছে দেশের একাধিক পরিবেশ সচেতন সংগঠন। কার্যত সেই আন্দোলনের জেরেই কেন্দ্রসরকার এই বিপন্ন প্রজাতিকে বাঁচাতে এক গুচ্ছ পরিকল্পনা করেছে। প্রথম ধাপ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উত্তরপ্রদেশ — মূলত যে তিনটি রাজ্যের মধ্য দিয়ে গঙ্গা বইছে, তাদের শুশুক গণনা করতে বলেছে কেন্দ্রীয় জলসম্পদ, নদীউন্নয়ন এবং গঙ্গাসংস্কার মন্ত্রক।সেই মতো বিহার ও উত্তরপ্রদেশের পাশাপাশি এই রাজ্যের সংশ্লিষ্ট দপ্তর গণনা প্রক্রিয়ার রূপরেখা পাঠিয়েছিল যদিও সেটি অনুমোদন পায়নি বলে মন্ত্রক সূত্রের খবর।
মন্ত্রকের এক মুখপাত্র-এর মত অনুযায়ী, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের পাঠানো প্রকল্প রিপোর্টটিতে তথ্যের অভাব রয়েছে,তাছাড়াও গণনার পদ্ধতি, ওই প্রক্রিয়ার সঙ্গে কারা যুক্ত থাকবেন, কর্মীদের অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা কতটা, সে সব তথ্য সবিস্তারে দেওয়া নেই।’’ সেই কারণে শুশুক গণনার বরাদ্দ টাকাও এখনও আটকে রয়েছে ।
যে প্রকল্পের অধীনে শুশুক গণনা হবে, সেই ‘স্বচ্ছ গঙ্গা অভিযান’-এ রাজ্যের নগরোন্নয়ন দফতরকে সামিল করেছে কেন্দ্র।
যে তিন রাজ্যের গঙ্গায় শুশুকদের আদি অবস্থান, তার মধ্যে উত্তরপ্রদেশ 2013 সালেই তাদের শুশুক গণনা শেষ করে ফেলেছে। বিহারের ‘ডলফিন ম্যান’ বলে পরিচিত; রবীন্দ্রকুমার সিংহ সম্পূর্ণ একক উদ্যোগে ভাগলপুরের বিক্রমশিলায় গঙ্গার 50 কিলোমিটার এলাকা জুড়ে তৈরি করে ফেলেছেন শুশুকের নিরাপদ বাসস্থান। সরকারি সহায়তায় প্রায় দু’যুগ ধরে চলছে বিহারে শুশুক বাঁচানোর লড়াই। আর পশ্চিমবঙ্গে বছর তিনেক আগে অসমের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে সুন্দরবনে শুশুক গোনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কিন্তু তাদের রিপোর্টকে মান্যতা দেওয়া হয়নি।
আমাদের রাজ্যে একাধিক বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে শুশুক নিয়ে গবেষণা চলছে বেশ কিছু বছর ধরে। WWF কলকাতা বিগত 20 বছর ধরে শুশুকের উপরে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে । 2013-2014 সাল পর্যন্ত নিয়মিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে গঙ্গা ছাড়াও চুর্ণি, জলঙ্গি, রূপনারায়ণ, দামোদর, দ্বারকেশ্বর ও শিলাবতী সহ রাজ্যের বেশ কিছু নদীতে এদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। দেশে গাঙ্গেয় শুশুক কমতে কমতে এখন 1600-এর কাছাকাছি দাঁড়িয়েছে। তাদের চর্বি থেকে তৈরি তেল মাখলে বাতের ব্যথার উপশম হয়, সাধারণ মানুষের এই ভ্রান্ত ধারণাই ওই জলজ প্রাণীর অস্তিত্বের সঙ্কট বাড়িয়েছে বলে মনে করেন জীববিজ্ঞানীরা এবং সেই ধারণা মূলধন করেই চোরাশিকারিরা নদীতে জাল পাতছে, চলছে দেদার চোরাশিকার!
এই প্রজাতি যে এখনও রাজ্যে টিকে আছে, তার একাধিক প্রমাণ মিলেছে। 2000 সালে পানাগড়ের রণডিহা লকগেটে আটকে গিয়েছিল একটি প্রমাণ মাপের পুরুষ শুশুক। 2012-তে সাড়ে 9 ফুটের একটা স্ত্রী শুশুক ঢুকে পড়েছিল ডায়মন্ড হারবারের একটি ইটভাটায়। 2009-তে পূর্ব মেদিনীপুরের তিলখোঁজা গ্রামে রূপনারায়ণের সেচখাল থেকে একটি শুশুক উদ্ধার করেছিলেন গ্রামবাসীরা। দক্ষিণবঙ্গের ছ’টি জেলায় দেখা মিলেছে গাঙ্গেয় শুশুকের। সম্প্রতি হলদিয়ার টাউনশিপের হলদি নদীর তীরে এবং মহিষাদলের বিভিন্ন জায়গায় গত কয়েক মাসে একাধিক ডলফিন ভেসে উঠতে দেখা গিয়েছে। মহিষাদলের গেঁওখালি এলাকায় ভেসে আসা একটি ডলফিনের মাংস কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে অভিযোগও উঠেছিলো। গত 27 জানুয়ারি হলদিয়ার টাউনশিপেই নদীর ধারে মৃত ডলফিন পড়ে থাকার ঘটনা সামনে আসে, প্রায়ই মৃত শুশুকের দেখা মিলছে। গেঁওখালি থেকে একটি শুশুকের দেহ উদ্ধার হয়। যে অবস্থায় শুশুকটি দেখা যায়, তাতে মনে হয়েছে তার দেহ থেকে মাংস কেটে নেওয়া হয়েছে। তবে কিছু ছোট শুশুকও মারা পড়ছে, যা সব চেয়ে উদ্বেগের বিষয়। মূলত বর্ষায় এদের বেশি দেখা যায়,হলদিয়া, কুকড়াহাটি, গেঁওখালি, নুরপুর প্রভৃতি এলাকায় নদীতে বিভিন্ন পকেটে; তবে বর্তমানে অনেক বেশি চোখে পড়ছে ওরা।
যে সব কারণে শুশুকের দল মারা পড়ছে –
• জলে লবণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া
• পছন্দের খাদ্য না পাওয়া
• জাহাজ বা ট্রলার চলাচলের পথে চলে আসা।
জাহাজের প্রপেলারে কাটা পড়ে হয় জখম হচ্ছে নয়তো মারা পড়ছে প্রাণীগুলি। এই ডলফিনরা জেলে নৌকার পাশে ঘোরা ফেরা করে মাছ খাওয়ার লোভে। অনেক সময় জালে জড়িয়ে মৃত্যু হয়। সংখ্যায় একাধিক ডলফিন থাকলে জাল ছিঁড়ে দিতে পারে। সেই আশঙ্কায় জেলেদের অনেকেই ডলফিন দেখে মাথা ফাটিয়ে দেন। হলদিয়ার এই অঞ্চলে মূলত গাঙ্গেয় ডলফিন দেখা যায়। লম্বায় প্রায় 1.5 মিটার এবং ওজন প্রায় 100-150 কেজি হয়ে থাকে, এদের চোখ কার্যত থাকে না। এদের গড় আয়ু 20-22 বছর হয় কিন্তু ডাঙ্গার আয়ু 10 থেকে 15 মিনিট মাত্র! এরা মিঠে জলে থাকে এবং ডলফিন ও শুশুকের প্রধান পার্থক্য হল এই বাসস্থান l ডলফিন নোনতা জলে থাকে l পুরুষ ডলফিন স্ত্রী ডলফিনের তুলনায় আকারে কিছুটা বড়ো হয়ে থাকে l 2-3 বছর অন্তর এরা একটি করে বাচ্চা জন্ম দেয় ।
এদের ব্লাইন্ড ডলফিনও বলে।শুশুকদের প্রধান খাদ্য মাছ। শিকারের অবস্থান নির্ণয়ের জন্য এরা অতিদ্রুতগামী শব্দ সংকেত ব্যবহার করে। এদের তৈরি শব্দ লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করলে তার প্রতিধ্বনি দ্রুত শুশুকের কাছে ফিরে আসে। এ প্রতিঘাত থেকে শুশুক তাৎক্ষণিকভাবে শিকারের আকার, দূরত্ব ও চলনের গতিবেগ নির্ণয় করতে সক্ষম হয়। এরা সমাজবদ্ধ প্রাণী, প্রায়ই দলবেঁধে চলাচল করে এবং শব্দ সংকেতের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে।
বাংলার নবদ্বীপের কাছে বালাগড়ের উত্তরে সবুজ দ্বীপ-সহ বেশ কিছু জায়গায় ইরাবতী ডলফিন ও গাঙ্গেয় ডলফিন দেখা যায়। ডলফিন শুমারি শুরু হয়েছে। শুমারি শেষ হলে ডলফিনের সংখ্যার সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে এবং সেই মতো সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে ।
ডলফিনের জন্য এক নতুন উদ্যোগ:
পরিবেশ নিয়ে সাম্প্রতিককালে চিন্তিত গোটা পৃথিবীই। প্রকৃতি ও বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যের অভাবের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে অজস্র প্রজাতি, অগণিত বন্যপ্রাণ। অন্তত যদি কিছু প্রজাতিকেও যদি বাঁচানো সম্ভব হয়, তবেই বজায় থাকবে জীববৈচিত্র্য। জলজ প্রাণী সংরক্ষণের ব্যবস্থা ভারতে ছিল দুর্লভ, দুর্বোধ্য একটি বিষয়। সম্প্রতি, সিন্ধু উপত্যকার বিয়াস নদীতে তৈরি করা হয়েছে 185 কিলোমিটার দীর্ঘ জলজ প্রাণী সংরক্ষণ প্রকল্প। দেশের প্রথম জলজ সংরক্ষণ প্রকল্প।
সিন্ধু নদ ও তার সঙ্গে যুক্ত নদীগুলিকে ঘিরে ছিল এক বিরল বাস্তুতন্ত্র। যদিও, নদীতে বাঁধ দেওয়ার ফলে তার অনেকগুলিই আজ বিপর্যস্ত, হারিয়ে যেতে বসেছে বহু উভচর সরীসৃপ শ্রেণীর প্রাণী;যেমন ঘড়িয়াল। সিন্ধু উপত্যকা অঞ্চলের বিখ্যাত ডলফিনও বিলুপ্তির পথে। দীর্ঘদিন ধরেই পরিবেশবিদরা এদের সংরক্ষণের কথা বলে আসছিলেন, কারণ বাস্তুতন্ত্রের এরাও গুরুত্বপূর্ণ সদস্য অবশেষে, সরকার তরফে নেওয়া হল সেই উদ্যোগ!
2017 সাল পর্যন্ত, দেশের কোনো নদীতে প্রাণী সংরক্ষণের জন্য আইনি ব্যবস্থা ছিল না। 2017 সালে বিয়াস নদীতেই প্রথম বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করা হয়। মূল উদ্দেশ্য ছিল ডলফিন সংরক্ষণ এবং তার সাথে সাথেই ঘড়িয়াল পুনর্বাসনের চেষ্টাও চালানো হচ্ছে। নদীতে এখন মাছ ধরার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, যাতে বিপন্ন প্রাণীরা কিছুতেই সমস্যায় না পড়ে। বর্তমানে বিয়াস নদীতে প্রায় 10টি ডলফিন আছে। তার সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে প্রায় 500 প্রজাতির পাখি ও 90টিরও বেশি মাছের প্রজাতি এক অনন্য বাস্তুতন্ত্র ।
ডলফিনের সংখ্যা বাড়লে তারা নদীর স্রোত ধরে পাকিস্তানের দিকে চলে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে নদীবাঁধ যেন তাদের রাস্তা না আটকায়, সেদিকেও নজর রাখা হবে। পাকিস্তানে জলজ প্রাণী সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। এই উদ্যোগ সফল হলে নিঃসন্দেহে সেখানকার বাস্তুতন্ত্রেরও উপকার হবে অনেকটাই।
দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশের অনেক ক্ষতি করেছে মানুষ। মানুষেরই দায়িত্ব প্রতিকার করা। প্রকৃতি পরিবেশকে বাঁচাতে এরকম উদ্যোগ আরো নেওয়া উচিত, এবং যত শীঘ্রই সে উদ্যোগ আমরা নেবে ততই মঙ্গল।
সৌভিক রায়