গুড় মিষ্টি চিনি মিষ্টি আরও মিষ্টি মধু
সবচেয়ে মিষ্টি দাদা মুখের কথা শুধু।।
উত্তর কলকাতার গিরিশ পার্কে ফ্রেন্ডস ইউনাইটেড ক্লাবে ছােটবেলায় একটা গান শিখেছিলাম। তারই দুটো লাইন উল্লিখিত।সত্তর-আশির দশকেও কলকাতার বিভিন্ন ক্লাবে, হয়ত গ্রামেও, খেলাধুলাের সঙ্গে ব্রতচারী বা অন্য নীতিশিক্ষা মূলক অনেক কিছুই শেখানাে হত।
যাক, যা গেছে তা যাক। মুখের কথা মিষ্টি-একথা না-মানার কোনাে মানে হয়! কিন্তু মুশকিল এই যে, মিষ্টি কথায় যেমন চিড়ে ভেজে না, স্বাদও হয় না। অগত্যা দোর ধরতে হয় গুড় বা চিনিরই। ‘জিবে প্রেম করে যেই জন’ সেই জনই জানে চিনির কদর, তা সে চিন্তামণিবাবুই দিক বা রেশনবাবু। “চিন্তামণি যিনি, চিনি জোগান তিনি” বলে একটা প্রবাদ আছে। কিন্তু জগতে এমন অনেক দুর্ভাগা আছে, যাদের পেটে ওরফে রক্তে রক্তে চিনি সয় চিনি সয় না, চিন্তামণি জোগালেও না। ‘চিনি চিনি করি চিনিতে (খেতে) না পারি,’ এই অধমদের জিবকে মিথ্যা মিষ্টিপ্রেমে মজাবার জন্যে আছে হরেক নকল মিষ্টি। ডায়াবেটিসে ভােগা লােকেদের খাবারে এই প্রক্সি দেওয়া মিষ্টি চালালে, তাদের জিবের তােয়াজও হয়, আবার রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে ঝুটঝামেলাও হয় না।।
এই প্রক্সিমিষ্টি অর্থাৎ সুইটেনিং এজেন্টদেরনদুটো জাত আছে। একটার কিছু পুষ্টিমূল্য থাকে, সেগুলােকে নিউট্রিটিভ বলে।আর একটায় কোনাে পুষ্টিমূল্য নেই। শুধু স্বাদ। এরা নন-নিউট্রিটিভ। যাদের ডায়বেটিস খুব বেশি অবাধ্য নয়, মােটামুটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে, তারা সাহস করে ক্যালােরিসমৃদ্ধ পুষ্টিকর নকল মিষ্টি চাখতে পারে। ফ্রকটোজ, সর্বিটল এবং জাইলিটল এই দলে পড়ে। এই তিনটের বায়ােডেটাতে একটু চোখ বােলানাে যাক।।
ফ্ৰকটোজ: অনেক মিষ্টি মিষ্টি ফলমূল ছেঁচেই একে পাওয়া যায়। চিনির চেয়ে দেড়গুণ বেশি মিষ্টি। ১২ ক্যালােরি শক্তি জোগান দিতে পারে।
সরবিটল: অনেক ফলেই এই মিষ্টি ফলে। এছাড়া গ্লুকোজের সঙ্গে হাইড্রোজেনের আলাপ-পরিচয় করিয়ে দিয়েও পাওয়া যেতে পারে। মিষ্টিত্বতে চিনির অর্ধেক হলে কী হবে, এটাও ৩৬ ক্যালােরি শক্তিতে ভরপুর। তবে বেশি খেলে সত্যিই এটা পেটে সয় না। ডায়ারিয়া হবার সম্ভাবনা থাকে।
জাইলিটল: তাল, স্ট্রবেরি, ফুলকপি ইত্যাদি গাছপালায় এর দেখা মেলে। মিষ্টি প্রায় সরবিটলের মতােই তবে ক্যালােরিতে ছােট; মাত্র ১৮। এটা বেশি খেলে আর গ্যাঁটের কড়ি ফেলে জোলাপ কিনে কিনে খেতে হয় না। এটাই জোলাপের কাজ করে দেয়।
নিপুষ্টি মিথ্যে-মিষ্টির মধ্যে সাইক্লোমেট, স্যাকারিন আর আসপার্টেম আছে। এর মধ্যে স্যাকারিনকে তাে শাহরুখ খানের মতই সবাই চেনে। মিষ্টত্বের ব্যাপারে চিনি, গুড় এর কাছে নেহাতই শিশু। এক ঝলক দেখা যাক ত্রি মাস্কেটিয়ার্সের দৌড় কতটা।
সাইক্লোমেট: গােরামার্কা দানাদার চেহারা। জলে গুলে জল হয়ে যায়। চিনির চেয়ে ৩০ গুণ বেশি মিঠে। ক্যালােরি-ফ্যালােরির চক্করে নেই। দিল্লি কে লাড্ডুর মতাে, খাওয়ার পর পস্তাতে হয়। কারণ মুখটা তিতকুটে হয়ে যায়। অবশ্য স্যাকারিনের মতাে অতটা নয়। ১৯৫০ থেকে ৭০, চিনিহীন হাল্কা পানীয়তে
(সফ্ট ড্রিঙ্কস) ব্যাপকহারে ব্যবহৃত হত। কিন্তু এ দিয়ে ইদুরদের আপ্যায়ন করে দেখা যায়, তাদের ব্লাডারে ক্যান্সার হচ্ছে। ফলে ইদুররা এটা খাচ্ছে কি না জানা গেলেও, ভারত ও আমেরিকাতে এটা মানুষের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। তবে উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপালেই হবে! প্রশ্ন তুলে অনেক দেশেই এর বহুল ব্যবহার কমেনি। কমলে ব্যবসা চলবে!
স্যাকারিন: ইরা রেমসেন নামে এক বিজ্ঞানী ১৮৭৯ সালে কি একটা আবিষ্কার করতে গিয়ে এটা আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। এরকমই একটা গল্প পড়েছিলাম।
‘কী চেয়েছি, আর কী যে পেলাম!’ বলে তিনি গান ধরেছিলেন কি না তাতে লেখা না থাকলেও রেমসেনের স্যাকারিন চায়ের কাপে তুফান তুলে দিল।চিনির চেয়ে মাত্র ৫৫০ গুণ বেশি মিষ্টি। হােমিওপ্যাথি ওষুধ এক লক্ষ গুণ তরলীকৃত করে। তাতে ওষুধের কণামাত্র থাকে কি না এই নিয়ে বিজ্ঞানীমহলে সংশয় আছে।
কিন্তু এক লক্ষ ভাগ জলে এক ভাগ স্যাকারিন গুলেও তাতে মিষ্টিসোনাকে চেনা গেছে। রসগােল্লা পরীক্ষার খাতায় যত বিরক্তিকর, প্লেটে ততই আদরনীয়। তাই ডায়াবেটিকদের টপাটপ রসগােল্লা গলাধঃকরণ করার জন্য স্যাকারিনের কাছে ঋণস্বীকার করতেই হয়। নানাভাবে স্যাকারিন ব্যবহৃত হলেও রান্নায় না দেওয়াই ভাল বলে বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন।
আসপার্টেম: প্রক্সি মিষ্টির মধ্যে এটাই প্রথম তৈরি হয়। মাত্র দু ক্যালােরি শক্তি ধরে বলে, একে কেউ পুষ্টিকর বলে গণ্য করে না। কারণ সমপরিমান চিনিতে মেলে ১৮ ক্যালােরি। চিনির চেয়ে ২০০ গুণ মিষ্টি হলেও এর স্বাদ বদখত নয়।
তৈরি চা-কফি (ইনস্ট্যান্ট টি-কফি, মানে গরম জলে ফেল আর খাও) বা মিষ্টি খাদ্যশস্যতে (প্রিসুইটেন্ড সিয়ারিয়েল) ইস্তক হস্তেমাল হয়। তবে হাতে তৈরি কেক, প্যাষ্ট্রি বা রুটিতে একে কাজে লাগানাে যায় না, কারণ ইনি তাপদগ্ধ হতে পারেন না। এটা খেয়ে কারও ক্ষতি হয়েছে এমন দাবি কেউ করছে না বলে, এটা দিব্যি গড়গড়িয়ে চলছে। এই হল অচিনি জগতের ছয় ঋতুর কথা।
পরিশেষে চিনি সম্পর্কে কিছু তিক্ত কথা। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান কয়েকটি জিনিসকে ‘হােয়াইট পয়জন’ বা সাদা বিষ বলে চিহ্নিত করেছে। সেই তালিকায় নুন, ময়দা, দুধ ইত্যাদির সঙ্গে চিনিও রয়েছে। স্ফটিকস্বচ্ছ চিনির রূপের যত বাহার, তার ক্ষতির বহরও তত। এমনকি চিনিকে ‘দ্য কার্স অভ সিভিলাইজেশন,সভ্যতার অভিশাপও বলা হচ্ছে। তাই পারলে চিনিকে না চেনার ভান করুন।
বরং গুড়কে নিকটবন্ধু করুন। দেখতে আহামরি না হলেও গুড়ে প্রচুর খনিজ লবণ, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি থাকে। চিনিকে রূপসুন্দরী করতে গিয়ে গুড়ের সব ভাল জিনিসই দূর করে দেওয়া হয় এবং সাদা ধবধবে করতে ব্লিচিং এজেন্ট হিসাবে যা মেশানাে হয়, তা আর যাই হােক স্বাস্থ্যের পক্ষে হিতকর নয়।।
সমীরকুমার ঘোষ