এখন কম্যান্ডো-পরিবত রাষ্ট্রনেতাদের বুলেট নিরােধক গাড়ি তাে থাকেই সঙ্গে থাকে বুলেট নিরােধক জ্যাকেটও। একটি হিন্দি ছবি এসেছিল ‘প্রাণ যায় পর বচন না যায়’। প্রাণ যাবে তবু কথার নড়চড় হবে না। এখন যুগধর্ম ‘বচন যায় পর প্রাণ না যায়’। আর সে জন্যেই বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটের কদর। আমাদের দেশে আধুনিক বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট যে তৈরি হয় না, তা না বললেও চলে। তবে দেশীয় নেতারা কি বেঘােরে মারা পড়বেন! মােটেও নয়। তাদের জন্য বিদেশ থেকেই আসে।
আগে ঢাল হাতে নিয়ে তরবারি জাতীয় কোনাে অস্ত্র থেকে আত্মরক্ষার রেওয়াজ ছিল। প্রথমে ব্রোঞ্জ এবং তার পরে পরেই লােহা আবিষ্কারে ব্যাপারটা জোরদার হয়। একাদশ এবং দ্বাদশ শতাব্দীতে যােদ্ধারা যে পােশাক-ঢাল ব্যবহার করত,তার নাম ছিল ‘চেন-মেল আর্মার (Chain-Imail armour)। অতি-তাগড়াই
চেহারা না হলে দামড়া এক লােহার পাত বুকে-পিঠে বেঁধে যুদ্ধ তাে দূরস্থান নড়াচড়াও হত দুষ্কর। কিন্তু চেন-মেল আর্মারের সুবিধে ছিল- ধাতুর তৈরি রিং বা চাকা একটার সঙ্গে একটা জুড়ে জুড়ে বেশ কয়েক স্তরবিশিষ্ট পােশাক বানানাে হত। যেটা নমনীয় এবং মজবুত দুই-ই ছিল। প্রায় ১২৫০ থেকে ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দ
পর্যন্ত পশ্চিম-ইউরােপ, পার্সিয়া এবং ভারতবর্ষে পদাতিক সৈন্যরা ব্রিগানডাইন (Brigandine) নামে এক ধরনের বর্ম ব্যবহার করত। এটা চামড়ার জ্যাকেটের ওপর বসানাে, একটু হালকা ধরনের বর্ম ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকান যুদ্ধবিমান চালকদের যে আধুনিক কায়দার বর্ম-পােশাক ‘ফ্ল্যাক’ (flac) দেওয়া হয়েছিল, ব্রিগানডাইন ছিল তারই পূর্বসুরি। ফ্ল্যাক জ্যাকেটের দুটো ভাগ ছিল।
এটা বুক ও পিঠের গলা থেকে কোমর পর্যন্ত ঢেকে রাখত। ২০ গেজের ম্যাঙ্গানিজ স্টিলের চৌকো চৌকো পাত ফেব্রিক দিয়ে মােড়া হত। পাতগুলাে একটার ওপর একটা এমনভাবে বসানাে থাকত যে, বুক থেকে গলা পর্যন্ত উঁচ গলারও জো ছিল না তাে বুলেট !
১৯৬০ সালে ডু পোঁ (Du Pont) এবং মনসান্টো কোম্পানি আলাদাভাবে এক ধরনের জৈব তন্তু (অর্গানিক ফাইবার) আবিষ্কার করল, যার সম্প্রসারণ ক্ষমতা।(টেনসাইল স্ট্রেন্থ) স্টিলের চার-পাঁচ গুণ বেশি। এই
সম্প্রসারণ ক্ষমতা মাপার নিত্তি হল ‘মেগা প্যাসক্যাল'(Mega Pascal, সংক্ষেপে MPa)।
১৯৭৩ সালে ডু পোঁ কোম্পানি অ্যারােমেটিক যৌগ থেকে এক ধরনের তন্তু তৈরি করে, যার সম্প্রসারণ
(টেনসাইল স্টিফনেস)কাঠিন্যক্ষমতা অনেক বেশি। সেই পলিআমাইড (আরামিড) তন্তুর নাম ‘কেভলার ২৯’। বুলেট- নিরােধক বর্ম হিসেবে ডু পৌঁর তৈরি এই হাল্কা অথচ মজবুত তন্তুই এখন ব্যবহৃত হয়। এর টেনসাইল স্ট্রেন্থ ২৮০০ এমপিএ।
যেখানে স্টিলের ঘনত্ব ৭.৮ গ্রাম/ঘন সেমি, সেখানে কেভলার ২৯-এর ১৪.৪ গ্রাম/ঘন সেমি। ওজন হিসাবে
(স্পেসিফিক) টেনসাইল ক্ষমতা কেভলারের ২২ গ্রাম/ডিনিয়্যার এবং স্টিলের ৫ গ্রাম/ডিনিয়্যার। ডিনিয়্যার হল ৯ কিমি তন্তুর ওজন গ্রাম হিসেবে। ০.০১৩ মিলিমিটার ব্যাস (ডায়ামিটার) বিশিষ্ট তন্তু দিয়ে কেভলার তৈরি, যেখানে ৪০ গেজ বিশিষ্ট স্টিলের তারের ব্যাস ০.১২২ মিলিমিটার।
এই রকম খটমট বৈশিষ্ট্য দিয়ে কেভলার যে চক্রব্যুহ তৈরি করে তা ভেদ করা বুলেটের কম্মাে নয়। এ রকম হাল্কা অথচ মজবুত বর্মই এখন দেশনেতা ও বিশিষ্ট ব্যাক্তিদের নড়বডে আত্মবিশ্বাস-ভরা, সদাকম্পিত বক্ষ রক্ষা করে চলেছে!
সমীরকুমার ঘোষ