ছােটো বেলায় কত এমন হয়েছে। অনুষ্ঠান বাড়িতে খেতে গিয়ে ঝালের জন্য মাংসের স্বাদই বুঝতে পারিনি। আবার কখনাে হয়তাে অসাবধানতা বশতঃ লঙ্কা খেয়ে চোখমুখ লাল হয়ে যেত। যতই জল খাই না কেন, ঝাল আর যায় না। এই রকম বিপদে কখনাে না কখনাে পড়েছি আমরা সবাই। কিন্তু তবুও লঙ্কা ছাড়া রান্নার কথা কোনাে বাঙালি পরিবারই এখনাে পর্যন্ত ভাবতে পারেন না! অথচ ভারতীয় রান্নায় এই লঙ্কার প্রচলন কিন্তু খুব পুরনাে নয়! এমনকি প্রাচীন সাহিত্যে গােলমরিচ,ত্রিফলা, পিপ্পলী প্রভৃতির কথা থাকলেও লঙ্কার উল্লেখ পাওয়া যায় না কথাও। মনে করা হয় ভারতীয়দের খাদ্যাভ্যাসে এর প্রবেশ ষােড়শ শতকে যখন পর্তুগিজ ব্যবসায়ীরা আমাদের দেশে আসেন।
তাহলে আরেকটু ভালাে করেই ফিরে দেখা যাক অতীতে।প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই পেরু, গুয়াতেমালা প্রভৃতি দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলিতে লঙ্কার পরিচিতি ছিল। তখন খ্রিস্টপূর্ব ৭৫০০ অব্দ। স্থানীয় বাসিন্দারা বুনাে ফল হিসাবেই জানত লঙ্কাকে। আরও মােটামুটি আড়াই হাজার বছর পর দেখা যায় পেরুর অধিবাসীদের খাদ্যতালিকায় প্রবেশ ঘটেছে লঙ্কার। এমনকি সে দেশের কৃষকরা চাষের জমিতেও লঙ্কাগাছ লাগাত, তবে পাখির অত্যাচার থেকে তাদের উৎপাদিত ফসলকে রক্ষা করার জন্য গৌণ ফসল হিসাবে।
ভৌগলিক দিক থেকে দেখতে গেলে আমেরিকা মহাদেশের মধ্যভাগ থেকে শুরু করে দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত আমাজন অববাহিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়েই দেখা মিলত লঙ্কার। তবে বহির্বিশ্বের কাছে এই অন্যতম
প্রধান মশলাটি কিন্তু অপরিচিত ছিল আরও কয়েক হাজার বছর।
অবশেষে ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে ইটালিয়ান নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাস মশলা-দ্বীপের খোঁজে এক ক্যারাবিয়ান দ্বীপে (যে অঞ্চলটি আধুনিক ক্যারাবিয়ান দ্বীপরাষ্ট্র বাহামাসের অন্তর্গত) এসে উপস্থিত হন। এই প্রথম ইউরােপীয়রা পা রাখলেন আমেরিকায়। মশলা হিসাবে সমগ্র ইউরােপে তখন সবচেয়ে বেশি চাহিদা গােলমরিচের। বাজারে তাে রীতিমতাে মহার্ঘ এই বস্তু! মাত্র এক পাউন্ড শুকনাে গােলমরিচ দানার
বিনিময়ে সেই সময়ে সহজেই একজন ক্রীতদাস ক্রয় করা যেত।কলম্বাসরা এই নতুন দ্বীপে পেয়ে গেলেন গােলমরিচ। সঙ্গে লাল রঙের অপেক্ষাকৃত বড় আরেকটি নতুন মশলা, লঙ্কা। ‘ব্ল্যাক পিপার’-এর সঙ্গে ‘চিলি পিপার’ ও দেশে নিয়ে এলেন তিনি। স্পেন ও পর্তুগীজ নাবিকদের হাত ধরে এই চিলি পিপার ছড়িয়ে পড়ল গােটা বিশ্বে।
তবে আমাদের দেশে লঙ্কার প্রচলন সম্ভবতঃ ভাস্কো-দা-গামার আগমনের পর থেকে। ক্রান্তীয় অঞ্চলের এই মশলার শুকনাে বীজ পর্তুগীজ নাবিকরাই এদেশে নিয়ে এসেছিলেন।
এবার দেখে নেওয়া যাক লঙ্কা খেয়ে ঝাল লাগার বিষয়টি। লঙ্কায় থাকা ক্যাপসেইসিন্যয়েড জাতীয় বিভিন্ন যৌগের উপস্থিতিই ঝালের জন্য দায়ী। তাই কোনাে নির্দিষ্ট প্রজাতির লঙ্কায় উপস্থিত এই ক্যাপসেইসিন্যয়েড পদার্থের পরিমাণের (যা হাই পারফরমেন্স লিকুইড ক্রোমাটোগ্রাফির (HPLC) সাহায্যে মাপা যায়) উপরেই নির্ভর করে তার ঝালের মাত্রা। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মাত্রায় থাকা পদার্থটি হল ক্যাপসেইসিন এবং ডাইহাইড্রোক্যাপসেইসিন। তবে এই নির্দিষ্ট পদার্থগুলি কিন্তু লঙ্কার বীজে থাকে না, ফলের ভিতরের যে সাদা অংশে বীজগুলি গাঁথা থাকে (যা প্লাসেন্টা নামে পরিচিত), সেখানেই থাকে ঝালের উদ্রেককারী এইসব পদার্থ। এই ধরণের যৌগগুলি মুখের ভিতরের মিউকাস পর্দায় থাকা নার্ভ রিসেপ্টারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ঝালের অনুভূতি সৃষ্টি করে। কেবল মুখের ভিতরেই নয়, শরীরের অন্যান্য উন্মুক্ত অংশে থাকা নার্ভ রিসেপ্টারের মাধ্যমেও একই রকম জ্বালা করার মতাে অনুভূতি সৃষ্টি করে এই ক্যাপসেইসিন্যয়েড যৌগগুলি। ১৯৯০ সালের শেষের দিকেই বিজ্ঞানীরা এই নার্ভগুলিকে চিহ্নিত করেছিলেন। তাই চুল ও নখ ছাড়া শরীরের যেকোনাে জায়গায়, অর্থাৎ স্নায়ুতন্ত্র আছে এমন দেহাংশেই লঙ্কার সংস্পর্শে জ্বালা করে। সঙ্গে গরম লাগতে থাকে এবং অনেক সময়ই খুব ঘাম হতে দেখা যায়। তবে দেহকোষের কোন স্থায়ী ক্ষতি সাধন কিন্তু এর ফলে হয় না। আসলে কোন জাতের লঙ্কাতেই এত বেশি
পরিমাণে ক্যাপসেইসিন থাকে না, যা আমাদের ক্ষতি করতে পারে।
তাছাড়া এই পদার্থটি তাে আর বিষাক্ত নয়! কিন্তু বেশি পরিমাণে থাকলে তা প্রাণ সংশয়ের কারণ হতেও পারে বৈকি। ইদুরের দেহে পরীক্ষায় দেখা গেছে প্রতি কেজি দেহের ওজনের জন্য মােটামুটি ৪৭.২ মিলিগ্রাম ক্যাপসেইসিন প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে।
কিন্তু শুধুই কি লঙ্কা? গােলমরিচ ও আদার মতাে মশলার ক্ষেত্রে এই ঝালের জন্য দায়ী পদার্থ হল পাইপেরিন এবং জিঞ্জেরােন।
আনবিক গঠনের দিকে খেয়াল করলে ক্যাপসেইসিন ও পাইপেরিন দুই ক্ষেত্রেই খানিকটা সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। আবার জিঞ্জেরােন তুলনামূলকভাবে ছােটো অণু এবং এর ঝালের ধরণও কিন্তু অন্যরকম।
এই অনুগুলির উপস্থিতি আমাদের মুখের লালাগ্রন্থিকে উত্তেজিত করে অতিরিক্ত লালারস নিঃসরণ করে ও হজমে সাহায্য করে। এমনকি পােষ্টিকতন্ত্রে খাদ্যদ্রব্যের চলনেও ক্যাপসেইসিন্যয়েড জাতীয় পদাথওলি
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে অনেকের ধারণা।
এবার দেখা যাক প্রচণ্ড ঝাল লাগলে তা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে কি করে? আসলে ক্যাপসেইসিন্যয়েড জাতীয় পদার্থের আনবিক গঠন লক্ষ করলেই দেখা যাবে প্রত্যেকের মধ্যেই হাইড্রোকার্বন শৃঙ্খল উপস্থিত রয়েছে। ফলে এরা জলে অদ্রাব্য, কিন্তু অ্যালকোহল, তেল এবং স্নেহজাতীয় দ্রাবকে দ্রাব্য। তাই জল খেলেও ঝালের অনুভূতি কিন্তু মােটেই কমে না। বরং এর থেকেই রেহাই পাওয়ার ভালাে উপায় দ্রুত কিছুটা দুধ খেয়ে নেওয়া। দুধে থাকা কেসিন নামক প্রােটিন ঝালের জন্য দায়ী ক্যাপসেইসিন বা অন্যান্য অণুগুলিকে আচ্ছাদিত করে ফেলে ও দ্রুত সেই স্থান থেকে অপসারিত করে আমাদের ঝালের অনুভূতি থেকে মুক্তি দেয়।
তবে লঙ্কা সম্পর্কে আরও কয়েকটি তথ্য জেনে নেওয়া যেতে পারে। ঝালের জন্য কোন স্তন্যপায়ী প্রাণীই (মানুষ ছাড়া) এই গাছ অথবা ফলকে খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করেন না। মূলতঃ তৃণভােজী প্রাণীদের হাত থেকে বাঁচার লক্ষ্যে এ যেন উদ্ভিদটির নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা! তবে পাখীদের দেহে ক্যাপসেইসিন্যয়েড যৌগের কোনাে প্রভাব নেই। ওদের পৌষ্টিকতন্ত্রের মধ্যে দিয়ে লঙ্কার বীজ অপরিবর্তিত অবস্থায় বেরিয়ে আসতে পারে ও মলের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। ফলে গাছের বংশ বিস্তারে সহায়তা হয়। কিন্তু স্তন্যপায়ী প্রাণীদের হজমতন্ত্রে এই বীজ পুরােপুরি বিনষ্ট হয়ে যায়।।
তবে এই ঝাল লাগার ব্যাপারটিকে কিন্তু উদ্ভিদ বিজ্ঞানী মার্ক পিকক একটু অন্যভাবে দেখে থাকেন। তার কথায় এই যন্ত্রণাকে আমি বলি “ছদ্ম যন্ত্রণা”, যা সত্যি দেহের কোনাে ক্ষতি না করে এইরকম যন্ত্রণাদায়ক
অনুভূতি সৃষ্টি করে (It’s what I call fake pain, It doesn’t actually cause you physical harm, even though it feels like it’)
অমিতাভ চক্রবর্তী