ইতিহাসের কি অদ্ভুত সমাপতন! একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি…….
অনুজীব যা প্রতিদিন আমাদের চ্যালেঞ্জ,করেই চলেছে প্রতি শতকে 100বছর পর পর ফিরে এসেছে মহামারী l মানব সভ্যতা আর বিজ্ঞান নিরুপায় হয়ে,বসে বসে দেখেছে মৃত্যু ! আমরা যে কতটা তুচ্ছ,প্রতিদিন সে প্রমান জোরালো থেকে জোরালোতর হচ্ছে…….
সালটা ছিলো 1720, (প্লেগ) বুবোনিক প্লেগ
1720 সালে পশ্চিম ইউরোপে মধ্যযুগীয় প্লেগের বড় আকারের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছিল। এই রোগটির ভাইরাস, গ্র্যান্ড সেন্ট আন্টোইন নামের একটি মার্চেন্ট জাহাজে পৌঁছেছিল, যখন জাহাজটি মধ্য প্রাচ্যে ভ্রমণ করছিলো সেই সময় সংক্রামিত যাত্রীরা উঠে পড়েছিলে জাহাজে। জাহাজটি ফ্রান্সের মার্সেলতে পৌছানোর পর পুরো শহরে শহরে ছড়িয়ে পরে রোগটি,একে ‘দি গ্রেট প্লেগ অফ মার্সেল’, ঘোষণা করা হয় । অগুনিত প্রাণহানি হয়,তাই একে ব্ল্যাক ডেথ আখ্যা দেওয়া হয় ।সংক্রমণ কমাতে মার্সেল-এর সীমানায় উঁচু প্রাচীর পর্যন্ত তুলে দেওয়া হয়েছিল। বিপুল প্রাণহানির এবং ভেঙে পরা আর্থিক অচলাবস্থা কাটিয়ে ছন্দে ফিরতে বেশ কয়েক বছর সময় নিয়েছিল পশ্চিম ইউরোপ।তবে এই সংকট বিজ্ঞান কে অনেক কিছু দিয়ে গেছে, প্লেগের কারণে 22 মাসের জন্য নিউটন কে পাঠিয়ে দেওয়া হয় হোম কোয়ারেন্টাইনে!ওই সময় তিনি 2টি গবেষণাপত্র লেখেন,তিনি তাঁর একটি চিঠিতে বন্ধুকে জানাচ্ছেন এই সময়তে তিনি পদার্থবিদ্যার নিত্য নতুন দিক নিয়ে ভাবতে শুরু করেন অর্থাৎ পদার্থবিদ্যার এক নতুন দিগন্তের ভিত্তি প্রস্থ স্থাপন করে এই মহামারী !
1820 – কলেরা
1817 সালে শুরু হয়ে,1824 পর্যন্ত চলেছিল ! 1820 সালে মহামারীর আকার ধারণ করে,ভারত,চীন এ প্রচুর প্রাণহানি হয়,ভারতের ব্রিটিশ সেনারাও আক্রান্ত হন,ভারত থেকে কলেরা সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পরে l
কলেরা থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইনেও ছড়িয়ে পড়েছিল।শুধু মাত্র জাভা দ্বীপেই এই কলেরার প্রাদুর্ভাবের ফলে 10 লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল। 1830সালে আবার প্রাদুর্ভাব দেখা যায় এবং 1832 পর্যন্ত যা স্থায়ী হয় l
1920 – স্প্যানিশ ফ্লু
1920 সালে পৃথিবী তখন সবে রক্তক্ষয় শেষ করেছে উঠেছে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পরে, সারাবিশ্ব স্পেনিশ ফ্লু ইনফ্লুয়েঞ্জার মহামারীর মুখোমুখি হয়েছিল। ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মকতম মহামারী ছিলো! যদিও 1918 থেকেই এর সূত্রপাত বলে মনে করা হয় l এই ফ্লু, পরবর্তী কয়েক বছরে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলো এই ফ্লু’তে।এটি পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষের মধ্যে সংক্রামিত হয়েছিল এবং এই ফ্লু’তে মৃত্যুবরণ করেছিলেন প্রায় এক কোটি ভারতীয়,এবং পৃথিবীতে সর্বমোট 5কোটি মানুষ মারা যান স্প্যানিশ ফ্লু তে!
2020 – করোনা
চীন থেকে আগত, সারা বিশ্ব ভীত- আতঙ্কিত হয়ে আছে এই করোনা ভাইরাসে।শেষ কোথায় হবে জানি না বাকি টা আগামী কয়েক দিনে সময় লিখবে l
সংখ্যাতত্ত্ব কোথায় থামবে কে জানে?
তবে প্রকৃতিও বোধহয় তার ছাকনি যন্ত্রটি ব্যবহার করছে,এই লকডাউনে দূষণ এবং বাতাসে দুষকের পরিমান অনেক কমেছে ! হয়তো আমাদের হাতের এন্ড্রয়েডটির মতো প্রকৃতিও তার সফটওয়ার আপডেট করে নিচ্ছে !
করোনা আর কিছু করুক বা না করুক বাংলাকে কোয়ারেন্টাইন,শব্দ টি জানিয়ে দিয়েছে ! দেখি এর আমদানি কোথা থেকে,কি ভাবে?
কোয়ারান্টা জিওরনি থেকে কোয়ারেন্টাইন শব্দটি এসেছে। এই ইতালীয় শব্দটির অর্থ 40 দিন। অসুস্থ ব্যক্তিকে সমাজ এবং পরিবার থেকে আলাদা স্থানে রেখে যত্ন নেওয়া বা চিকিৎসা করা, যার ইতিহাস কিন্তু বেশ পুরনো।প্রামাণ্য হিসেবে, ‘বুক অব লেভিটিকাস’ বই টি কে ধরা যেতে পারে, এই বইটি খ্রিস্টপূর্ব 538-332 এই সময়ের মধ্যে লেখা হয়েছে।এই বইয়ের বিবরণ অনুযায়ী , ওই সময়ে যেসব মানুষ লেপ্রসি বা কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হতো তাদের সমাজ ও পরিবার থেকে আলাদা করে রাখা হতো।
40 অর্থাৎ, নির্দিষ্ট সংখ্যার দিন কেন? এমন প্রশ্ন আসতেই পারে। এর পেছনেও রয়েছে একটি প্রাচীন ইতিহাস ।পৃথিবীতে কোয়ারেন্টাইনের প্রচলন শুরু হয় চতুর্দশ শতকে। সমুদ্র উপকূলবর্তী শহরগুলোতে প্লেগের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্লেগ আক্রান্ত এলাকা থেকে ইতালির ভেনিসে যেসব জাহাজ আসত তাদের 40 দিন অপেক্ষা করতে হতো বন্দরে প্রবেশের জন্য,এই ঘটনা থেকেই কোয়ারেন্টাইন শব্দটির আগমন হয়।
এই পদ্ধতি এতটাই কার্যকর হয়েছিল যে পরবর্তী 300 বছর কোনো প্রকার সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে, কোয়ারেন্টাইনের পথ অবলম্বন করা হতো এবং সময়সীমা 40 দিন বহাল থাকতো ।
পরবর্তীতে 1918 সালে, যখন বিশ্বব্যাপী স্প্যানিশ ফ্লু মহামারি আকার ধারণ করে, তখন আমেরিকা ও ইউরোপের স্বাস্থ্যকর্মীদের দাবি মেনে, আক্রান্ত ব্যক্তিদের আলাদা রাখার ব্যবস্থা করা হয়। কারণ, ভাইরাস টি ছিলো সংক্রামক এবং বাতাস, কফ ও থুতুর মাধ্যমে তার বিস্তার লাভ করার সম্ভবনা ছিলো l ওই সময়ে রোগীদের মধ্যে যাদের অবস্থা গুরুতর তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং যাদের অবস্থা গুরুতর নয় তারা বাড়িতে চিকিৎসাধীন ছিলো, এরপর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কোয়ারেন্টাইনকে আইনের দ্বারা বাধ্যতামূলক করে এবং এই আইন ভঙ্গ করলে,ভঙ্গকারীর শাস্তির বিধিও রয়েছে আইনে !
সৌভিক রায়