আপনি মানুষ বলেই ভাববেন না যে পৃথিবীতে একমাত্র মানুষরাই কথা বলতে পারে,প্রতিটির প্রাণীরই নিজস্ব ভাষা আছে এবং সেই ভাষায় তারা কথা বলে; ভাবের আদান প্রদান করে এবং সর্বোপরি সুসংবদ্ধ ভাবেই করে যা আমাদের থেকে অনেক সুশৃঙ্খল ভাবে সম্পন্ন হয় !হলিউডের সেই ডঃ ডুলেটেল কে মনে আছে যিনি পশুপাখিদের ভাষা বুঝতেন,তাদের সাথে তাদের ভাষায় কথা বলতেন ! প্রাণিজগতের এই সমন্বয় সাধন কোনো আশ্চর্যের চেয়ে কম নয়,কোনো অংশে বরং এ এক জীববিদ্যার জটিল দিক কিন্তু কত সহজেই প্রাণীরা সেটি ব্যবহার করে l আজ পতঙ্গদের কিছু ভাষার কথা আমরা জানবো,
প্রথমেই আসি ফেরোমোনের কথায়,যা পতঙ্গদের এবং প্রানীদের মধ্যেও দেখা যায়,এটি একপ্রকার ভৌত-রাসায়নিক সংকেত প্রদানকারী রাসায়নিক পদার্থ যা নির্দিষ্ট কিছু কোষ থেকে ক্ষরিত হয়, ফেরোমোন অন্ত প্রজাতির মধ্যে ক্রিয়াশীল; অর্থাৎ নির্দিষ্ট প্রজাতির মধ্যেই ফেরোমোন ক্রিয়াশীল ! ফেরোমোনের সাহায্যে পতঙ্গ, খাদ্যে এবং শত্রুর সংকেত প্রদান করে অন্য পতঙ্গদের l ফেরোমোনের সাহায্যে পতঙ্গ তার বিপরীত লিঙ্গের পতঙ্গকে প্রজননের বার্তা প্রেরণ এবং সংগমের আহ্বান জানায় l
বিয়োলুমিনেসেন্স, এক কথায় বলতে গেলে, জোনাকির সেই মিট মিট আলো!এটি একটি রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে উপজাত পদার্থের সাথে কিছু টা আলো উৎপন্ন হয় l তাই একে কেমোলুমিনেসেন্সও বলা হয়ে থাকে,লুমিনেসেন্স শব্দের অর্থ হলো আলোক উৎপাদন l কিছু কিছু ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রেও এই ঘটনা দেখা যায়,এই রাসায়নিক বিক্রিয়ায় যে আলো উৎপন্ন হয় তাকে,কোল্ড লাইট বলা হয় কারণ বিক্রিয়ায় যে আলোক উৎপন্ন হয় তার উষ্ণতা সাধারণ আলোর চেয়ে অন্তত 20 শতাংশ কম হয় l পতঙ্গ-এর মাধ্যমে নানান জৈবনিক প্রক্রিয়ায় সংকেত প্রেরণ করে এবং প্রতিক্রিয়ার সমন্বয় সাধন করে l
ফন ফ্রিঙ্ক,একজন জার্মান এনটামলজিস্ট অর্থাৎ পতঙ্গবিদ মৌমাছির ভাষা আবিষ্কার করেন। মৌমাছি হলো সমাজবদ্ধ পতঙ্গ,এরা একটি দলে বাস করে এবং এদের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণী বিভাগ আছে ; কাজ এবং আকার আকৃতির ভিত্তিতে তাদের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় l তিনি পরীক্ষামূলকভাবে মৌমাছির জন্য মৌচাক ও খাদ্যউৎসস্থান তৈরি করেন। মৌচাক থেকে ওই খাবার পাওয়ার অর্থাৎ উৎস স্থানগুলো ১০০ থেকে ৩০০ গজ দূরে দূরে স্থাপন করেন। তিনি নির্দিষ্ট কিছু আচরণ লক্ষ করেন, যে ওইসব খাদ্যউৎস স্থানে খাবার পর্যাপ্ত পরিমানে থাকলে কর্মী-মৌমাছি বাসায় ফিরে মৌচাকের সামনে এক রকম নাচ দেখায়। যদি ওইসব জায়গায় যথেষ্ট পরিমাণে খাবার না থাকে তবে তারা নাচ দেখায় না।
আবার নাচের মধ্যেও বেশকিছু রকমফের রয়েছে। মৌচাকের খুব কাছে খাবার থাকলে তারা একরকম চক্রাকার বা গোলাকার নাচ দেখায়। কিন্তু যদি মৌচাকের থেকে বেশি দূরে খাবার থাকে তবে তারা এদিক-ওদিক ঘুরে বাংলার ‘৪’ সংখ্যার মতো দেখায় এক বিশেষ প্রকার নাচ দেখিয়ে থাকে। একে ইংরেজিতে ওয়াগেল নৃত্য বলে।
নাচের মধ্য দিয়ে আবার,মৌচাকের কোন দিকে খাদ্যবস্তু রয়েছে তাও নির্দেশ করা হয়ে থাকে। মৌচাকের নিচের দিক থেকে ওপর দিকে মৌমাছির সোজাসুজি নাচ আরম্ভ হলে বোঝায় খাদ্য উৎস সূর্যের দিকে। কিন্তু যদি মৌমাছি নাচের সময় মৌচাকের ওপর থেকে নিচের দিকে যায় তবে বোঝায় যে খাবারের উৎস সূর্যের বিপরীত দিকে আছে। এভাবে মৌমাছি নাচের ধরণ,সংখ্যা এবং ওড়ার কোন বিশেষ প্রকৃতির রকমফেরের মধ্য দিয়ে নানা রকম খবর তাদের দলের অন্যান্য মৌমাছিকে দিয়ে থাকে,এবং বিভিন্ন প্রকারের নাচ দেখে অন্য মৌমাছিরা সেটি বিশ্লেষণ করে l একে দুর্দান্ত কোঅর্ডিনেশন ছাড়া কি বলবেন,একজন খাবারের খবর আনলো তারপর বাকি দলের সদস্যরা সেই খাবার গিয়ে সংগ্রহ করলো,এর চেয়ে সুশৃঙ্খল আর কি হতে পারে, এরপরেও বলবেন আমাদের চেয়ে সভ্যজীব আর নেই !আসলে বন্যরাই বেশি সভ্য,সুন্দর কারণ তারা মিথ্যে বলতে পারে না !
©সৌভিক রায়