উত্তর ভারত মহাসাগরে সৃষ্ট সামুদ্রিক ঝড়ের নাম ঠিক করে তীরবর্তী সংশ্লিষ্ট ১৩ টি দেশ পর্যায়ক্রমিক ভাবে, ১৬ বছর আগে ২০০৪ এ থাইল্যান্ড-এর দেওয়া ঝড়ের নাম হলো ‘আমফান’ যার অর্থ ‘আকাশ’ ,এর আগে ২০১৩ তে থাইল্যান্ড আরেক ঝড়ের নাম দিয়েছিলো ‘ফাইলিন’যার অর্থ ছিল নীলকান্তমণি। ভারত বেশ কয়েকটি ঝড়ের নাম দিয়েছে যেমন অগ্নি,বায়ু,জল এবং আকাশ ।
পৃথিবীর মোট ১১ টি সংস্থা যা গঠিত হয়েছে একাধিক দেশ নিয়ে,তারা ঝড়ের নামকারণ করে থাকেন কোন মহাসাগর থেকে ঝড় উঠছে তার উপর ভিত্তি করেই ঠিক হয়,কোনো সংস্থার দেওয়া নাম গৃহীত হবে।
প্রায় ১৬০ টির মতো নাম শেষ হয়েগেছে,এই বছর আবার নতুন করে নামকরন চলছে। এরপরের সাইক্লোনের নাম হিসেবে গতি, নিসর্গ ইত্যাদি নাম ঠিক হয়ে আছে।
গত বছরের দুই ঝড় ফেনী ও বুলবুল,ফেনী নাম দিয়েছিলো বাংলাদেশ যার অর্থ ফণা যুক্ত সাপ এবং বুলবুল নাম দিয়েছিলো পাকিস্তান।আমফানের পরবর্তী ঘূর্ণিঝড়গুলির নাম হবে নিসর্গ (বাংলাদেশের প্রস্তাবিত), গতি (ভারতের প্রস্তাবিত), নিভার (ইরানের প্রস্তাবিত), বুরেভি (মালদ্বীপের প্রস্তাবিত), তৌকতাই (মায়ানমারের প্রস্তাবিত নাম), ইয়াস (ওমানের প্রস্তাবিত)।
পশ্চিমঙ্গে আছড়ে পড়েছে আমপান। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রাণহানি পর্যন্ত হয়েছে। আমপান সুপার সাইক্লোনের তকমা পেয়েছে আবহাওয়াবিদদের তরফে । একটা বিষয় লক্ষ্য করলেই, আমাদের সকলেরই চোখে পড়বে যে, যতদিন যাচ্ছে সাইক্লোনের সংখ্যাও ততই বাড়ছে। ফনি যেতে না যেতেই বুলবুল, তারপর এখন আমফান যেন একটার পর একটা উপদ্রব লেগেই রয়েছে। এর কারন শুধুই প্রাকৃতিক নয় আমরাও এর জন্য সমান ভাবে দায়ী ! সেটাই,আমাদের সময় এসেছে সত্যউপলব্ধির,প্রয়োজন রয়েছে প্রকৃতিকে।
আগে যে সাইক্লোন হত না সেটা নয়, কিন্তু এত কম সময়ের ব্যবধানে এত বেশি সংখ্যায় সাইক্লোন আগে হত না। শুধু বঙ্গোপসাগর নয়, আরবসাগরের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। ২০১৪ তে নিলোফার, ২০১৫ সালে মেঘ, সাইক্লোনের সংখ্যা ক্রমশঃ বাড়ছে।
শুধু সংখ্যাই নয়, বাড়ছে সাইক্লোনগুলোর তীব্রতাও। নিলোফার, মেঘ, ফণি সবই এক্সট্রিমলি সিভিয়ার ট্রপিকাল সাইক্লোনের পর্যায়ে পড়ে। এদের ক্ষেত্রে হাওয়ার গতিবেগ ঘণ্টায় ১৮০ কিলোমিটারের বেশি। গবেষণায় জানা যাচ্ছে গত এক শতকে প্রতি পাঁচ বছরে, আর আগের পাঁচ বছরের তুলনায় তিনটি করে বেশি সাইক্লোন হচ্ছে। শুধুমাত্র ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল, এই দশ বছরে আগের ১০ বছরের তুলনায় ৬ টি সাইক্লোন বেশি হয়েছে। এর কারণ হিসেবে উঠে আসছে গ্লোবাল ওয়ার্মিং। গ্লোবাল ওয়ার্মিং যত বাড়ছে, ততই পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বাড়ছে। ফলে বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠে জলের তাপমাত্রাও। এই তাপমাত্রা 27 থেকে 28 ডিগ্রির বেশি হলে সাইক্লোনের জন্ম হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের জলের তাপমাত্রা আগের থেকে অনেক বেশি সময় ধরে 28 ডিগ্রির বেশি থাকছে। শুধু ভারত মহাসাগরেই নয়, প্রশান্ত মহাসাগর কিংবা আটলান্টিক বিশ্বজুড়ে সব জায়গাতে একই অবস্থা।
যার ফলে,বিগত কয়েক দশকে সাইক্লোন এর সংখ্যা বেড়েছে, বেড়েছে তীব্রতাও। শুধু আমফানের তাণ্ডবলীলাই নয়, প্রকৃতির দেওয়া রক্ষাকবচ ধ্বংসের বিরুদ্ধেও লড়াই দিয়ে যাচ্ছে!
উপকূলবর্তী অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ, সাইক্লোনগুলির প্রথম ধাক্কা সামলায় ম্যানগ্রোভ। তার ফলে জনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে ঢোকার আগেই সাইক্লোনের তীব্রতা অনেকটা কমে যায়।
গত বছর আমরা দেখেছি, ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গের উপকূলবর্তী ম্যানগ্রোভ অরণ্য বুলবুলের গতিকে ঘণ্টায় প্রায় কুড়ি কিলোমিটার কমিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ম্যানগ্রোভের এই প্রাকৃতিক দেওয়াল প্রতিবছর কমছে। দীঘার সমুদ্রের পাড়ে বিশাল ঝাউবনগুলো শুধু আপনার বিনোদনের জন্য তৈরি করা হয়নি। প্রকৃতি সেই ঝাউবন তৈরি করেছে ঝড় থেকে আপনাকে বাঁচাবার জন্য।সেই ঝাউবনকে প্রতিদিন ধ্বংস করে আমরাই রিসর্ট বানাই। গত দুই দশকে সুন্দরবন অঞ্চলের ম্যানগ্রোভের পরিমাণ চার ভাগের এক ভাগ কমে গিয়েছে। যার মূল কারণ হলো সরকারের ভ্রান্ত পরিবেশ নীতি ও গ্লোবাল ওয়ার্মিং। ভারতবর্ষের ৭৫০০ কিলোমিটার উপকূল যা নানান জীববৈচিত্র্-এর আধার, তাকে বাঁচানোর বদলে তাকে নষ্ট করার জন্য একের পর এক আইন আনতে চলেছে সরকার।
১৯৯১ সালে ভারতে প্রথম কোস্টাল রেগুলেশন নোটিফিকেশন আনা হয়, যেখানে হাই টাইডলাইন থেকে ৫০০ মিটার পর্যন্ত এলাকাকে কোস্টাল রেগুলেশনের আওতায় আনা হয় (সিআরজেড), যার ১০০ মিটার ছিল ‘নো ডেভেলাপমেন্ট জোন’ অর্থাৎ ওই অঞ্চলে কোনো ধরনের প্রকল্পই করা যাবে না। কিন্তু ১৯৯৪ সালে এটিকে সংশোধন করে নো ডেভেলাপমেন্ট জোন যা হাই টাইড লাইন থেকে ১০০ মিটার পর্যন্ত ছিল, তাকে কমিয়ে ৫০ মিটার পর্যন্ত করা হয়। তার বাইরের এলাকা কনস্ট্রাকশনের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
২০০১ এ আবার এটিকে সংশোধন করা হয় এবং অ্যাটমিক এনার্জি প্রোজেক্টের জন্য পাইপ লাইন পাতার অনুমতি দেওয়া হয়। ২০০২ থেকে ২০১৫ এর মধ্যে এই নোটিফিকেশন বারবার সংশোধন করে হোটেল, রিসোর্ট করার পারমিশন দেওয়া হয়, এমনকি ইকো সেনসিটিভ এরিয়াতেও। ২০১৮ তে আবার ৬০৬৮ কিলোমিটার কোস্ট লাইন খুলে দেওয়া হয় ডেভলপমেন্ট প্রজেক্টের জন্য। কাজেই বুঝতেই পারছেন উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলি হোটেল, রিসর্ট, ব্যবসার কাজে ব্যবহার করার ঢালাও অনুমতি দেওয়া হয়েছে। যার ফলে উপকূলবর্তী অঞ্চল ধরে বারবার ম্যানগ্রোভ কাটা হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে প্রকৃতির নিজস্ব সুরক্ষা-বর্ম।
তারপর এক রামে রক্ষা নেই সুগ্রীব দোসর গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর ফলে সমুদ্রের জলের উষ্ণতা বাড়ায় বেশি পরিমাণ লবণাক্ত জল ঢুকে যাচ্ছে সুন্দরবন অঞ্চলে। যার প্রভাবে ওই অঞ্চলের মাটি বেশি লবণাক্ত হয়ে যাচ্ছে আর অতিরিক্ত লবণের কারণে প্রায় ৫-১০% ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ প্রতিবছর মারা যাচ্ছে। ম্যানগ্রোভের কমে যাওয়া আসলে সাইক্লোনের স্থলভাগে ক্ষয়ক্ষতি করার ক্ষমতাকেই বাড়িয়ে দেয়। আপাতভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আকারে এই সাইক্লোন হাজির হলেও, মানুষের তৈরি দূষণ ও সরকারের ভ্রান্ত পরিবেশ নীতিরই ফলাফল সাইক্লোন বেড়ে যাওয়া এবং তার ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বহু গুনে বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ ।
ঘূর্ণিঝড়ের মোকাবিলায় যে সর্তকতা জারি হয়, যা আমরা ঝড়ের আগে পিছে নিয়ে থাকি,তা যদি আমরা সারা জীবনের জন্য পরিবেশ রক্ষায় নিতে পারে তবেই মঙ্গল।হয়তো আগামী বছরও আমফান আসবে অন্য নামে কিন্তু আমাদের পরিবেশই আমাদের রক্ষা কবচ হতে পারে প্রকৃত অর্থেই,তাই যে সবুজ আমফানে নষ্ট হলো তা দ্রুত পূরণ করতে হবে আমাদের। আমাদের বাঁচানোর দায়টা পরিবেশের ওপরেই ছেড়ে দেব আমরা l কারণ সবুজ প্রকৃতিই আমাদের রক্ষা করবে’।
এবং আরো একটি বিষয় মনে রাখবেন, পরিবেশ কিন্তু সব মনে রাখে আর ধারণ ক্ষমতা পর্যন্ত !
যত বেশী গাছ নির্বিচারে কাটা পড়বে, শেষ হবে সবুজ,জলাশয় বোঝানো হবে, দূষণ বাড়বে, তত উষ্ণায়ন বাড়বে, তত তাড়াতাড়ি সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রাও 27℃ ছাড়াবে এবং বার বার হবে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি । ফলস্বরূপ এরকম বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হওয়ার প্রবণতা আরো বাড়বে এবং সেই ঝড়ের ধ্বংসলীলা, ভয়াবহতা আরও বাড়বে। এই বিষয়টা বিগত কয়েক বছর ধরেই লক্ষণীয় কারণ মে জুন মাস থেকেই এরকম ট্রপিক্যাল সাইক্লোন তৈরি হচ্ছে যেটা স্বাভাবিক সময়ের আগে এবং প্রায়ই চরম গতিবেগ নিয়ে পৌঁছচ্ছে স্থলভাগে । সুতরাং বাঁচতে হলে গাছ বাঁচান, জলাশয় বাঁচান। গত পঞ্চাশ বছরে এ ঝড় দেখেনি বাংলা , এখনো সময় আছে বাঁচান পৃথিবী সবটাই আমাদের হাতে নয়তো; এখন যে ঝড় 190 কিলোমিটার বেগে এসে গাছ ভাঙছে। এরপর 290-কিলোমিটারে এসে,আপনার সাধের বাড়ি নগরায়ন সৌখিন সভ্যতা আর প্রযুক্তি বিজ্ঞানের দম্ভকে এক টানে উপড়ে ফেলব।
সৌভিক রায়