শিল্প ভাবনায় প্রফুল্লচন্দ্র
প্রায় দেড়শত বছর আগে অধুনা বাংলাদেশের যশােহর জেলার রাঢুলি-কাটিপাড়া গ্রামের জন্মেছিলেন যে ছেলেটি তিনিই পরবর্তীকালে হয়ে উঠেছিলেন বিশিষ্ট রসায়ন বিজ্ঞানী। মাস্টার অফ নাইট্রাইটস্ নামে
যিনি সমধিক পরিচিত। প্রফুল্লচন্দ্র গুধুই বিজ্ঞানী নন। বিজ্ঞান সাধনার সাথে সাথে পরাধীন ভারতের মুক্তির স্বপ্নও তিনি দেখতেন। প্রকৃতই একজন দেশপ্রেমিক।
তদানীন্তন অনুন্নত সমাজের উন্নয়নের লক্ষ্যে সমাজ সংস্কারের ভূমিকাতেও অবতীর্ণ হয়েছিলেন তিনি।
পরাধীন ভারতের দুর্বল শিল্প কাঠামাে তাঁর মনকে উদ্বেল করত। তাই শিল্পের প্রসারেও ছিল তাঁর নিরলস প্রচেষ্টা। দেশীয় শিল্পের উন্নয়নে মনপ্রাণ সোপে ছিলেন।
ভারতবর্ষ তখন পরাধীন। পরাধীন ভারত শিল্পের দিক থেকে পিছিয়ে ছিল অনেকটাই। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত অনেক জিনিসই তখন আমদানি করা হত বিদেশ থেকে। বিষয়টি প্রফুল্লচন্দ্রের মনকে নাড়া দিত সর্বদা। ঔষধপত্র, কাপড়চোপড়, কাচের বাসনপত্র এমনকি সূঁচটি পর্যন্ত এদেশে উৎপাদিত হত না। আমদানি করা হত বিদেশ থেকে।
নিত্য ব্যবহার্য্য এসব জিনিসের জন্য ভারত ছিল পরমুখাপেক্ষী। প্রফুল্লচন্দ্র একদমই বরদাস্ত করতে পারতেন না বিযয়টি। সর্বদাই ভাবতেন স্বাবলম্বী হওয়ার কথা। তাই কলকাতায় থাকাকালীন সময়ে নিজের খরচ-খরচা চালিয়ে যা কিছু উদ্বৃত্ত থাকত তাই নিয়েই শুরু করেছিলেন রাসায়নিক কারবার। শুরু হল শিল্পোদ্যোগ প্রেসিডেন্সী কলেজে অধ্যাপনা করার সময়ে দেশীয় শিল্পের দুর্দশা তাঁর মনকে বিচলিত
করত।
রূপসী বাংলার প্রকৃতিতে যে অজস্র সামগ্রী ছড়িয়ে রয়েছে তাকে কিভাবে শিল্পের উপাদান হিসেবে কাজে লাগানাে যায় সেই চিন্তা তাকে আকুল করে তুলেছিল। শিল্পের প্রসার ঘটলে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের অনাহারব্লি্ট যুবকদের মুখে অন্ন যােগানাে যাবে এই স্বপ্নই দেখতেন তিনি। কাজও শুরু করে দিলেন লেবুর বিশ্লেষণ করে তৈরি করলেন সাইট্রিক অ্যাসিড। কিন্তু ব্যাপাবটি সুবিধাজনক হল না। কেননা
তখনকার দিনে কলকাতায় লেবুর যােগান যেমন ছিল না তেমনি লেবু সস্তাও ছিল না। তাই লেবু থেকে তৈরি সাইট্রিক অ্যাসিড বিক্রি করে লাভের সম্ভাবনা ছিল খুবই কম। তাই ছেড়ে দিলেন সাইট্রিক অ্যাসিডের কারবার। ভারতে বসলেন অন্য বিষয়ের কথা। এমন জিনিস তৈরি করতে হবে যাতে উৎপাদনের খরচ কম, বাজারে কাটতিও বেশি। ফলে লাভের অঙ্কও হবে বেশি। আবার আর্থিক ব্যাপারটিও ভাবতে হবে। মূলধন কম লাগে এমন জিনিস উৎপাদনের কথাও ভাবতে হবে। অনেক ভেবে চিন্তে শেষ পর্যন্ত ভেষজ বা ওষুধ সংক্রান্ত দ্রব্য তৈরির দিকেই ঝুঁকলেন।
সে সময় ফসফেট অফ সােডা এবং সুপার ফসফেট অফ লাইম আমদানি করা হত বিদেশ থেকে। প্রফুল্লচন্দ্রের বিষয়টি ধাক্কা দিল। তিনি দেখলেন যে, গবাদি পশুর হাড়গােড় থেকে এসব জিনিস তৈরি হয় তা তাে এদেশেই প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এদেশ থেকে সেগুলি বিদেশে রপ্তানী করা হয়। তাহলে এসব দ্রব্য এদেশে তৈরি করা যাবে না কেন?
শুরু হল প্রচেষ্টা। হাড়ভস্মকে কাজে লাগানাে হল। সালফিউবিক অ্যাসিডের সহযােগে তৈরি হল সুপার ফসফেট অফ লাইম। এর সঙ্গে সােডার প্রতিক্রিয়ায় তৈরি হল ফসফেট অফ সােভা। তৈরি হল এক আশ্চর্য টনিক। এরকম আরও অনেক রাসায়নিক দ্রব্য যা এতদিন পর্যন্তও বিদেশ খেকে আমদানি
করা হত তা প্রফুল্লচন্দ্র নিজের প্রচেষ্টায় এ দেশেই তৈরি করতে সফল হলেন।ক্রমে ক্রমে গড়ে তুললেন এক ওষুধের কারখানা বেঙ্গল কেমিক্যালস এন্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস।
বাঙালী তথা ভাবতবাসীকে শিল্পোেদ্যোগী হবার আহ্বান প্রফুল্লচন্দ্রের চিরাচরিত চাকুরীব আশায় বসে না থেকে বঙ্গসন্তানেরা ব্যবসার প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে নিজের পায়ে দাঁড়াক এই ছিল তাঁর স্বপ্ন। তাই অন্নবস্ত্রহীন হাজার হাজার ছেলেকে নিরাশ চোখে কলকাত শহরের এদিক থেকে ওদিকে হা চাকরি হা চাকবি করতে করতে ঘুরতে দেখে তাঁর মন দুঃখে ভবে যেত। তিনি বলতেন ‘ভারতবাসী এখনও ঘােরো, সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে শিল্প-বাণিজ্য ব্যবসায় মন দাও, তবে যদি বাঁচতে পারাে নইলে তােমাদের ভবিষ্যৎ নেই।”
রতন দেবনাথ
লেখাটি বিজ্ঞান অন্বেষক এর বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায় পুস্তিকায় ২০১০ সালে প্রকাশিত