জাপানি শব্দ সুনামি (Tsunami) সু’ এবং নামি’ এই দুটি শব্দের সংযােগে তৈরী। সু’ অর্থ ‘Harbour’ বা ‘পােতাশ্রয়’ এবং নামি’ অর্থ wave বা তরঙ্গ।
জাপানে সুনামি
জাপানে প্রায়ই সুনামির আনাগােনা ঘটায় তারা এর সঙ্গে সুপরিচিত। কিন্তু সুনামি নিজে একটি প্রাকৃতিক ঘটনা নয়, বরং ভূমিকম্পের ন্যায় প্রাকৃতিক ঘটনা ।ফলে সংঘটিত সামুদ্রিক জলােচ্ছাসজনিত প্রাকৃতিক
বিপর্যয়। প্রকৃতপক্ষে এর উৎপত্তির জন্য কি কারণ নিহিত আছে, সেটাই দেখা যাক।
সুনামির কারন
মহীসঞ্চরণ ও প্লেট ভূগঠন মতবাদের আলােকে ব্যাখ্যা : ১৯১২ সালে জার্মান আবহতত্ত্ববিদ আলফ্রেড ওয়েগনার তার মহীসঞ্চরন মতবাদে বলেন,মহাদেশ ও মহাসাগরগুলি প্রথম থেকেই বর্তমান অবস্থায় ছিল না। মহাদেশগুলি একত্রে প্যানজিয়া ও মহাসাগরগুলি প্যানথালাসা নামে পরিচিত ছিল। ক্রমে জোয়ারি শক্তি ও বৈষম্যমূলক অভিকর্ষজ শক্তি মূলত এই দু’রকম বলের প্রভাবে প্যানজিয়া মূল দুটি অংশেবিভক্ত হয়ে পড়ে ।যার উত্তরাংশটি আঙ্গারাল্যান্ড ও দক্ষিণাংশটি গন্ডােয়ানাল্যান্ড নামে
পরিচিত ছিল।
ক্রমে কোটি কোটি বছর ধরে সঞ্চরণের ফলে মহাদেশ ও মহাসাগরগুলি বর্তমান আকৃতি লাভ করেছে। পৃথিবীর উপরের স্তর বা ভূ-ত্বক দুটি ভাগে বিভক্ত যার উপরের অংশটি সিয়াল (Sial)। যা সিলিকন
ও অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে ও নীচের স্তরটি সিলিকন ও ম্যাগনেশিয়াম দিয়ে তৈরী সিমা (Sima)।
হালকা সিয়াল স্তরটি অপেক্ষাকৃত হালকা গ্রানাইটজাতীয় শিলা দিয়ে তৈরী । মহাদেশীয় অংশ গঠন করেছে। ভারী সিমান্তর ব্যাসল্টজাতীয় পদার্থ দ্বারা গঠিত এবং মহাসাগরীয় অংশ গঠন করেছে।
ওয়েগনার বলেন, এই হালকা মহাদেশীয় সিয়াল স্তরটি ভারী মহাসাগরীয় সিমান্তরের ওপর ভাসমান ও বিনা বাধায় সঞ্চারন করছে।
পরবর্তীকালেপিডো, উইলসন, মরগ্যান প্রমুখ প্লেট ভূ-ঘটন মতবাদের অবতারণা করেন। এই মতবাদে কোটি কোটি বছর পূর্বে একত্রিত থাকা। মহাদেশগুলির নাম দেওয়া হয় ‘ক্রেট’ এবং বলা হয়, ভূ-ত্বক বিচ্ছিন্ন কয়েকটি অংশের সমষ্টিবিশেষ যারা চুতিরেখা দ্বারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন।
মহাদেশের লায় এই অংশগুলাের গভীরতা ১৫০ কিমি এবংমহাসাগরের তলায় প্রায় ৭০ কিমি এবং এগুলি ভূ-ত্বকের নীচে অ্যাসথেনােস্ফিয়ার (গুরুমণ্ডল) পর্যন্ত বিস্তৃত। এক একটা প্লেটে শুধুমাত্র মহাদেশ বা মহাসাগর বা অংশত মহাদেশ ও মহাসাগর নিয়ে তৈরী।
ভূ-পৃষ্ঠে এরকম ৭টি বড়, ৮টি মাঝারি ও ২০টিরও বেশী ক্ষুদ্র প্লেট আছে। গ্রেটগুলাে কিন্তু স্থির নয়,
বছরে কয়েক মিলিমিটার থেকে কয়েক সেন্টিমিটার গতিতে সঞ্চরণশীল।
এখন প্রশ্ন হলাে প্লেটগুলাে গতিশীল কেন? ব্যাসথেনেশ্চিয়ারে সৃষ্টপরিচলন স্রোতই প্লেটগুলােকে গতিশীল রাখে বলে ভূ-তাত্ত্বিকদের অভিমত।
নিম্ন অ্যাসথেনােস্ফিয়ারে অত্যন্ত চাপ ও তাপে সান্দ্র অবস্থায় থাকা পদার্থসমূহ উত্তপ্ত ও হালকা হয়ে উপরের দিকে এবং পরের অপেক্ষাকৃত শীতল পদার্থনীচের দিকে নেমে আসলে চক্রাকারে পরিচলন
স্রোতের সৃষ্টিহ্যা এবং তার প্রভাবেই প্লেটেরসঞ্চরণ ঘটে।
কখনও গ্রেটগুলি পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, কখনও পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে,
আবার কখনও পাশাপাশি একে অপরকে অতিক্রম করছে। আগেই বলা হয়েছে মহাসাগরীয় প্লেট অপেক্ষাকৃত ভারী শিলায় গঠিত।
কাজেই, সঞ্চরণকালে যদি একটি মহাদেশীয় প্লেটের সাথে একটি মহাসাগরীয় গ্রেটেবসংঘর্ষ হয়, তবে ভারী মহাসাগরীয় প্লেটহালকা মহাদেশীয় প্লেটের নীচে তির্যকভাবে একটি ঢাল বরাবর চালিত হয়।
এই ঘটনা যেকোনাে দুটিহালকা ও ভারী প্লেটের সংঘর্ষের ফলেই ঘটে।এই ঘটনার অবশ্যম্ভাবী ফল হিসাবেই ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। উদাহরণস্বরূপ দক্ষিণ আমেরিকা গ্রেট ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় গ্লেট সংঘর্যের কথা উল্লেখ করা যায়, যার প্রভাব দেখা যায় এল নিনাে সৃষ্টির ক্ষেত্রেও।
সাম্প্রতিক (২০০৪ সালের) সুনামির উৎপত্তিও প্রভাব :
সাম্প্রতিক ভূমিকম্পযার ফলস্বরূপ এই সুনামি বিপর্যয় তাও উপরােক্ত ভৌগলিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা
করা যায়। চলমান মহাদেশীয় প্লেট মায়ানমার প্লেট মহাসাগরীয় প্লেট ভারতমহাসাগরীয় প্লেটের সংঘর্ষে অপেক্ষাকৃত ভারী ভারত মহাসাগরীয় প্লেটটি পিছলে মায়ানমার প্লেটের নীচে চলে যায় প্রায় ৪০ ফুট এবং
একবার নয়, পরপর তিনবার।
দুটি প্লেটের মধ্যে পিছলে যাবার প্রথম ঘটনাটি ঘটে সুমাত্রার একেবারে উত্তরপ্রান্তের কিছুটা পশ্চিমে।এবং পরের দুবার ঘটে আগের স্থানটির কিছুটা উত্তরে। এই ঘটনারই অনিবার্য ফল হিসাবে প্রবল ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয় যার কেন্দ্রটি ছিল সুমাত্রার কাছে ভারত মহাসাগরের প্রায় ৪০ কিমি গভীরে। রিখটার স্কেলে এইভূ-কম্পের মাত্রা ছিল ৮.৯। সুমাত্রার কাছে ভূ-কম্পনের ঘটনাটি ঘটে সকাল সাড়েছ’টা নাগাদ এবং ভারতে অনুভূত হয় এর ৩০ থেকে ৩৫ মিনিটের মধ্যে। এই প্রবল ভূ-কম্পনই উলম্ব বা খাড়াভাবে সমুদ্রের জলকে ঠেলে তােলে এবং মুহুর্তে ফুলে ফেপে ওঠা জলতরঙ্গ অতি দ্রুত ঘণ্টায় ৫০০- ৬০০ মাইল বেগে মাঝসমুদ্র থেকে ধেয়ে চলে উপকূলভাগের দিকে।
কিন্তু মজার কথা হলো সমুদ্রের মাখানে সুনামির গতি যতই বেশী হােক, তরঙ্গের আকার বা দৈর্ঘ্য তেমন উল্লেখযােগ্য নয়। এক-একটি ঢেউয়ের উচ্চতা কয়েক ফুট মাত্র। কিন্তু সেই তরঙ্গই যখন উপকূলের
দিকে আসে,তখন তা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে এবং মূল ভূ-কম্পের প্রাবল্যের অনুপাতে এক-একটি ঢেউ ২০ থেকে ১০০ ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়ে ওঠে।
উপকূলের দিকে সমুদ্রের গভীরতা যত কমে, ততই সুনামির গতিবেগ কমে এবং মহীসােপানে ধাক্কা খেয়ে rolling process-এ তরঙ্গগুলি বেশী উন্মত্ত হয়ে সাপের ফনার মতাে ধেয়ে আসে। তবে কেবলমাত্র উলম্ব
অর্থাৎউপরে নীচে কম্পনের ফলেই সুনামি সৃষ্টি হয়। এরূপকম্পনের ফলে সমুদ্রের জল অপসারিত হওয়ার পরে পরেই অভিকর্যের টানে ভারত মহাসাগরীয় ও মায়ানমার প্লেটের সংঘর্ষ নীচে নেমে এসে সাম্যাবস্থায় ফিরে আসার চেষ্টা করলেই তৈরীহয় সুনামি।
সুনামি সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি এবং আফ্রিকার পূর্ব। উপকূলবর্তী সােমালিয়া দেশের সামাজিক আর্থিক ইত্যাদি দিকে যে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছে, সেকথা এখানে নতুন করে বলার অবকাশ নেই।
বরং উল্লেখ করা যায়, এইসকল দেশের তথা সমগ্র পৃথিবীর ভৌগলিক পরিবর্তনেও সুনামি উল্লেখযােগ্য প্রভাব ফেলেছে। উপগ্রহ থেকে তােলা চিত্রে দেখা গেছে, আন্দামান-নিকোবর ও ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপগুলির
অনেকাংশই সমুদ্রবক্ষে নিমজিত হয়েছে, কোথাও বা জেগে উঠেছে নতুন স্থলভাগ! প্লেটগুলির তিনবার পিছলে যাওয়ার যে প্রচণ্ড শক্তি নিতি হয়েছে বা প্রায় ২০ কোটি টন ট্রাই-নাইট্রো টলুইন বিস্ফোরণের সমান।
তাতে উত্তর সুমাত্রা থেকে উত্তর আন্দামান পর্যন্ত ১২০০ কিমি এলাকায়। সমুদ্রবক্ষে বিশাল ফাটল ধরেছে এবং ১০ বছর পর জেগেউঠেছে ব্যারন আগ্নেয়গিরি। স্থায়ীভাবে পৃথিবীর ঘূর্ণনের বেগ বেড়ে গিয়ে দিনের সময় কমেছে মাইক্রোসেকেন্ড।ঘসে হয়েছেআন্দামানের প্রবাল দ্বীপগুলি।
শুধু তাই নয়, এর ফলে হিমালয় সংলগ্না ভারত ও চীনের আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটবে, বৃষ্টিপাত কমে দেখা দেবে খরা আবার তাপমাত্রা বেড়ে হিমবাহ গলে প্লাবিত হতে পারে হিমালয়ের পাদদেশ।
তবে,সুনামি নিয়ে যত বিস্ময়ই থাক, প্রকৃতপক্ষে এটি একটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা।VS.A র ন্যাশনাল জিওফিজিক্যাল ডেটা সেন্টারের তথ্যানুযায়ী ১৯৯০-৯৯-এর মধ্যে বিশ্বজুড়ে হওয়া ৯৭০টি সুনামির মধ্যে
৮৪২টি ছিল নিরীহ।
তবে ভারত মহাসাগরে এধরনের মেগা-সুনামি না। ঘটায় আমাদের কাছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের তালিকায় এটি নতুন নাম। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৮৩ সালের ২৭শে আগষ্ট কারাকাটাউ আগ্নেয়গিরি জেগে ওঠায় প্রকাণ্ড ভূমিকম্পে ও সুনামির প্রভাবে জাভা ও সূমাত্রার।
প্রায় ৩৬ হাজার মানুষ মারা যান। জাপানের মতাে দেশে যেখানে সুনামি পরিচিত ঘটনা সেখানে ভূ-কম্প তরঙ্গ ব্যাখ্যা করে সুনামির পূর্বাভাস দেবার ব্যবস্থা আছে।
ভারতসহ দক্ষিণ এশীয় দেশগুলিতেএধরনের ব্যবস্থা না থাকলেও শীঘ্রই সুনামি ওয়ার্কিং ব্যবস্থা চালু করার চেষ্টাচলছে। আশার কথা, বিজ্ঞানীরা বলেছেন ভূমিকম্পের আগাম সতর্কবাণী দেওয়া সম্ভব
হলেও সুনামির আগাম সতর্কতা দেওয়া সম্ভব।
তবে ভাবলে অবাক লাগে না পশু-পাখিরা তাদের শরীরস্থিত রিসেপটরের সাহায্যে টের পেয়েছিল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের যা টের পায়নি বেশীরভাগ উন্নত আবহাওয়া দফতরগুলি। বাতাসসমুদ্র ও পাখিদের গতিবিধি আঁচ করার মতাে প্রাকৃতিক শিক্ষাই অক্ষত রেখেছে আন্দামানের জারােয়া, ওঙ্গীদের।
যেখানে কংক্রীটের দেওয়াল জলােচ্ছাসে টুকরাে টুকরাে হয়ে গেছে সেখানে ম্যানগ্রোভের
জঙ্গল ও প্রবাল প্রাচীর অটুট থেকে আঘাত শােষকের কাজ করেছে।
সেজন্যই সুনামির মতাে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা পেতে পশু-পাখিরা রিসেপটরের সাহায্যে যন্ত্র তৈরীর বা প্রাকৃতিক দাওয়াই হিসাবে ম্যানগ্রোভ ও প্রবাল প্রাচীরের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার কথা নতুন করে ভাবা হচ্ছে।
শাশ্বতী মিত্র,
শিক্ষিকা, শামনগর কাভিচউচ্চ বিদ্যালয়
লেখাটি বিজ্ঞান অন্বেষক এর ২০০৫এর মার্চ-এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত