আমরা একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাব বাঁচার জন্য কী লড়াইটাই না করে চলেছে।
আমাদের চারপাশে অবস্থিত পশু, পাখি, মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী তথা সমগ্র জীবকুল।
খাদ্য অনুসন্ধান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও শত্রুর হাত থেকে নিজেদের বাঁচানাের সাথে সাথে সবসময় তারা লড়ে চলেছে রােগজীবাণুর হাত থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার তাগিদে।
আর এই লড়াইয়ে তারা নিজেদের দেহজ প্রতিরক্ষাতন্ত্র বা ইমিউন সিস্টেম কে বানিয়েছে মূল হাতিয়ার। তাই কোনও প্রাণী জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলে বুঝতে হবে তার দেহজ প্রতিরক্ষাতন্ত্র ঠিকমত কাজ করছে না—পরিণতি জীবাণুর হাতে পরাজয় ও রােগাক্রান্ত হওয়া।
বর্তমানে প্রাণীসম্পদ বিকাশের তাগিদে এখন বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে প্রাণীপালন ও মৎস্যচাষের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। স্বভাবতই তাদের স্বাস্থ্যের দিকটা দেখাশােনার দায়িত্ব আরও ভালভাবে কি করে ব্রা যায় তার চেষ্টা চলছে ব্যাপকভাবে।
সামগ্রিকভাবে প্রাণীস্বাস্থ্য উন্নয়নে তাই অনেকটাই জোর দিতে হচ্ছে দেহজ প্রতিরক্ষাতকে সজীব ও কার্যকর করে রাখার ওপর।
আর সেটা করতে সাহায্য নিতে হচ্ছে কিছু পদ্ধতির যা সরাসরি জীবাণু প্রতিরােধে বিশেষ ভূমিকা নেবে। বিভিন্ন পদ্ধতিতে টিকাদানের (ভ্যাকসিনেশনের) কথা এই প্রসঙ্গে জেনে নেওয়া যাক।
প্রাণী সুস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য আমরা সাধারণত যে সমস্ত টিকা (ভ্যাকসিন)গুলাে ব্যবহার করে থাকি, তার মূল উপাদান হচ্ছে রােগসৃষ্টিকারী কিছু পঙ্গু / মৃত জীবাণু ৰা তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অথবা রাসায়নিক পদ্ধতিতে তৈরি তাদের দেহের মতাে বা অঙ্গের মত কিছু
টিকা বা ভ্যাকসিন-কী ও কেন?
জীবাণু। ভ্যাকসিনের প্রসঙ্গ এলে এয়ার্ড জেনারের নাম এসে পড়ে। জেনারই (১৭৯৮
খ্রিঃ) প্রথম মানুষ যিনি স্মল পক্স বা গুটি বসন্তের টিকা আবিষ্কার করেন। তিনি কাও পঙ্গ
বা গাে-বসন্তের কিছু জীবাণু (আসলে এগুলি ছিল বিষাণু / ভাইরাস) ব্যবহার করেন গুটি
বসন্তের হাত থেকে রােগীকে বাঁচাতে।
গুটি বসন্তের জীবাণু মানুষের দেহে রােগসৃষ্টি না করে উন্টে তার দেহজ প্রতিরক্ষাতন্ত্রকে চাঙ্গা হতে সাহায্য করে যা কিনা পরবর্তীকালে গুটিবসন্তের জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সার্থক ভূমিকা পালন করে।
এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণে রাখার জন্য পরবর্তীকালে লুই পাস্তুর টিকাদানকে ভ্যাকসিনেশন ও টিকাকে ভ্যাকসিন বলে উল্লেখ করেন। ল্যাটিন ভাষায় ভ্যাক্কা শব্দের অর্থ গরু। গােবসন্ত প্রসঙ্গে
গরু তথা ভ্যাকা শব্দটি থেকেই ভ্যাকসিন শব্দটির উৎপত্তি।
মানুষের মত বিভিন্ন গৃহপালিত প্রাণী ও মাছের সুস্বাস্থ্যের তাগিদে আজকাল ব্যবহৃত হচ্ছে রকমারি সব ভ্যাকসিন। গৃহপালিত পশু ও পাখির বেলায় টিকাসামগ্রীকে চামড়ার তলায় (সাবকিউটেনিয়াস), পেশিতে (ইস্ট্রামাসকিউলার), পেরিটোনিয়ামে, ত্বকে (ইন্ট্রাডারমাল) অথবা শিরায় (ইন্ট্রাভেনাস) ইনজেক্শন করতে হয়। আবার কয়েকটিকে খাবারের সাথেখাওয়ানও (ওরাল) হয়।



মাছের বেলায় ইনজেকশন ছাড়াও কিছু সময় ভ্যাকসিনযুক্তজলাশয়ে তাদের চোবান হয় বা শুধুই ছেড়ে দেওয়া হয়।
বিভিন্ন রােগের জন্য বিভিন্ন রকমের টিকার ব্যবস্থা আছে। তবে অধিকাংশই জীবাণুদের দ্বারা তৈরি রােগের বিরুদ্ধে। সে জীবাণু ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা ছত্রাক যা কিছু হতে পারে।
তবে সবার ক্ষেত্রেই টিকাসামগ্রীর উপাদান তৈরির মূল নীতিটি একইভাবে মেনে চলা হয়। টিকার উপাদান তৈরির পদ্ধতিকে কয়েকটি আগে ভাগ করা হয়।
এদের মধ্যে একটি হচ্ছে জীবিত কিন্তু রােগসৃষ্টিতে অক্ষম জীবাণুর ব্যবহার, অন্যটি হচ্ছে মৃত / পঙ্গু জীবাণুর ব্যবহার, কিছু ক্ষেত্রে জীবাণুর পরিবর্তে রাসায়নিক পদ্ধতিতে সংশ্লেষিত জৈবাণুর ব্যবহার (সিন্থেটিক পেপ্টাইড) অথবা জৈব প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে রিকমবিন্যা্ন্ট জীবাণুর ব্যবহার।
পরিশেষে জীবাণুর ডি, এন, এর সরাসরি ব্যবহার। এছাড়া গবেষণাগারে কোশ চাষের (সেল কাচার) মাধ্যমেও ভ্যাকসিন তৈরি করা হচ্ছে।
তদানীন্তন ভ্যাকসিনগুলাের মধ্যে জীবিত এবং বিভিন্ন পদ্ধতিতে (বিশেষত তাপ বা রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে) তৈরি মৃত / পঙ্গু জীবাণুর ব্যবহারই চোখে পড়ত।
তবে বর্তমানে জৈব প্রযুক্তি (বায়ােটেকনােলজি)-র কল্যাণে আমরা এখন বাজারে নতুন প্রজন্মের
টিকা (নিউ জেনারেশন্ ভ্যাকসিন)ও দেখতে পাচ্ছি। একথা মানতেই হচ্ছে যে রিকবিন্যান্ট ডি, এন, এ প্রযুক্তি আজ চিকিৎসাবিজ্ঞানে এক নতুন জোয়ার এনেছে।
উন্নত বৈজ্ঞানিক গবেষণা টিকা তৈরির উপাদান ও ব্যবহারে বৈচিত্র্য এনেছে। এরা নানাভাবে দেহজ
প্রতিরক্ষাতন্ত্রকে চাঙ্গা করার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ভ্যাকসিন সাধারণত এককভাবে দেওয়া হয় না। এটি একপ্রকার রাসায়নিক পদার্থের সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করা হয়। তারা কার্যত ভ্যাকসিনের কর্মক্ষমতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। এই সমস্ত রাসায়নিক পদার্থগুলােকে ‘অ্যাডজুভেন্ট’ বলে।
অ্যাডজুভেন্টগুলাের মধ্যে কিছু আছে অ্যালুমিনিয়াম বা পটাশিয়ামের লবণ, কিছু আছে তৈলজাতীয় পদার্থ আবার কিছু রাসায়নিক পদ্ধতিতে উৎপন্ন জৈবাণু বিশেষ। এরা প্রত্যেকেই কিছু না কিছুভাবে দেহজ
প্রতিরক্ষাতন্ত্রের উপাদানগুলােকে আরও সচল ও কর্মদক্ষ করে তােলে।অ্যাডজুভেন্ট ও ভ্যাকসিনের উপাদান ও কার্যকলাপ নিয়ে আজ এক উন্নত বিজ্ঞান গড়ে উঠেছে, যার নাম অ্যাডজুভেন্ট।
গঠনশৈলী বা ব্যবহারের পদ্ধতি আলাদা হলেও ভ্যাকসিনের মূল কর্মনীতি কিন্তু অভিন্ন। তাহ’ল প্রতিরক্ষাতন্ত্রের কিছু কোশকে উদ্দীপিত করা যা পরিশেষে কিছু কার্যকরী জৈবাণু (অ্যান্টিবডি) তৈরি করবে অথবা ঘাতক কোশ (সাইটোটক্সি সেল) তৈরিতে কার্যকরী ভূমিকা নেবে। যারা কিনা ভবিষ্যতে রােগ সৃষ্টিকারী জীবাণুদের প্রতিহত করতে পারবে।
অর্থাৎ আগাম রােগের থেকে বাঁচবার জন্য লড়াইয়ে নিজেকে প্রস্তুত রাখতে ভ্যাকসিনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই আজ চিকিৎসাবিজ্ঞানের তথা প্রাণী ও মৎস্যবিজ্ঞানের গবেষণায় জৈব প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে উন্নতর ভ্যাকসিন তৈরির প্রয়াস এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে যা ভবিষ্যতে সুস্বাস্থ্যরক্ষায় তার প্রাপ্য মর্যাদা সে আদায় করে নেবেই।
লেখক
সিদ্ধার্থ জোয়ারদার ও অনিন্দিতা জোয়ারদার
লেখাটি গবরডাঙ্গা গবেষণা পরিষৎ থেকে প্রকাশিত
আধুনিক জীববিদ্যা ও জনস্বাস্থ্যের সহজপাঠ থেকে সংগৃহিত।