আধুনিক টিকার জনক—এডওয়ার্ড জেনার (Edward Jenner )
অতীতে সারা বিশ্বে যে সব রােগ মহামারি সৃষ্টি করেছে, তাদের মধ্যে ভাইরাস ঘটিত রােগ অন্যতম (যেমন গুটি বসন্ত, ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রভৃতি)। এছাড়া কিছু জীবাণু ও পরজীবী ঘটিত রােগ মহামারীর জন্য দায়ী। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কলেরা, প্লেগ ও কালাজ্বরের কথা।
মহামারী দেখা দিলে চিকিৎসার মাধ্যমে রােগীকে সারানাের থেকেও, সুস্থ অথচ রােগ হতে পারে এমন মানুষের প্রতিষেধক (টিকা)-এর মাধ্যমে রােগটির প্রতিরােধ করার ব্যবস্থা অনেক সময়েই বেশি উপযােগী হয়। তবে তার জন্য যেটা দরকার তা হল গণ- টিকাকরণের ব্যবস্থা করা। থাকতে হবে ঐ রােগ প্রতিকারের উপযুক্ত টিকা (ভ্যাকসিন)।

টিকাকরণের মাধ্যমে কিছু রােগ সারা পৃথিবী থেকে চিরতরে নির্মূল করা গেছে, এমন
উদাহরণও আছে। এদের মধ্যে মানুষের গুটি বসন্ত ও গবাদি প্রাণীর রিন্ডারপেস্ট (ক্যাটেল
প্লেগ) রােগ উল্লেখযােগ্য।
প্রথমটি মানুষের হলেও এর নির্মূলকরণে গবাদি প্রাণীর ভূমিকা আছে। বসন্ত প্রাণীদের মধ্যেও হয়। গােবসন্ত, ছাগ বসন্ত, শূকর বসন্ত, পক্ষী বসন্ত প্রভৃতি। তবে গুটি বসন্ত রােগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসের সমগােত্রীয় হলেও প্রাণী বসন্তের বিষাণু (ভাইরাস)দের আকৃতি ও প্রকৃতিতে সামান্য কিছু পার্থক্য রয়েছে।
তারা মানুষের দেহে তত ভয়াবহ রােগ সৃষ্টি করতে পারে না। অথচ এরা মানুষের দেহজ প্রতিরক্ষাতন্ত্রকে চাঙ্গা করতে পারে। এই বিশেষ কার্যকারিতাকে কাজে লাগিয়ে ১৭৯৬ সালে প্রথম টিকাকরণ চালু হয়।
গোবসন্তের বিষাণু প্রয়ােগ করা হয় মানুষের দেহে। তার দেহে গড়ে ওঠে গুটি বসন্তের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ! জেহাদ ঘােষিত হয় বসন্ত নামক বিভীষিকা সৃষ্টিকারী মহামারীর বিরুদ্ধে।
এটি ঘটে গ্লোসেস্টারশায়ার নামক ইংল্যান্ডের এক অখ্যাত গ্রামে। এই যুগান্ত সৃষ্টিকারী ঘটনাটির জনক একজন চিকিৎসক। নাম এডওয়ার্ড জেনার। যিনি ভ্যাকসিন তথা ইমিউনােলজি (দেহজ প্রতিরক্ষাবিজ্ঞান)র জনক বলে স্বীকৃতি পেয়েছেন।

এডওয়ার্ড জেনার ১৭৪৯ সালের ১৭মে ইংল্যান্ডের বার্কলি’তে জন্মগ্রহণ করেন।
বাবা ছিলেন গ্রামের এক সাধারণ ধর্মযাজক। মাত্র ৫ বছর বয়সে এডওয়ার্ড অনাথ হয়ে পড়েন।
বড়ো দাদার কাছে এডওয়ার্ড মানুষ হন। পেশায় দাদাও ছিলেন ধর্মযাজক। বড়াে
হয়ে এডওয়ার্ড অবশ্য চিকিৎসক হয়েছিলেন।
ডাক্তারি শিখেছিলেন প্রথমে ড্যানিয়েল লাডলাের কাছে শিক্ষানবিশ হিসাবে। এরপর একুশ বছর বয়সে লন্ডনের সেন্ট জর্জেস হাসপাতালে কাজ শিখতে যান। সেখানে শিক্ষাগুরু হিসাবে পান জন হান্টার-এর মত প্রখ্যাত চিকিৎসকের সান্নিধ্য।
শিক্ষা শেষে বার্কলির গ্রামে ফিরে আসেন ও প্র্যাকটিস শুরু করেন। এ সময়ে দুরারােগ্য গুটি বসন্তের বহু রােগীকে প্রত্যক্ষ করেন। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে বসন্তের মহামারীতে ইউরােপে প্রায় ৬ কোটি লােকের মৃত্যু হয়।
এশিয়াতেও এই মহামারীর প্রকোপ ছিল ভয়াবহ। চিন ও তুরস্কদেশে সে সময় এই রােগের এক প্রতিরােধী টিকাকরণ ব্যবস্থা চালু ছিল। বলা হত ‘ভ্যারিওলেশন্। এই পদ্ধতিতে বসন্ত আক্রান্ত রােগীর গুটির
মধ্যে একটি সুতাে ঢুকিয়ে দেওয়া হত। তাতে ঐ সুতােয় গুটির পুঁজ-রস লেগে যেত।
এবার কোন সুস্থ লােকের হাতের একটি অংশে ছুরি দিয়ে কেটে ক্ষত তৈরি করা হত এবং
ঐ পুঁজ-রস মাখানাে সুতােটি তাতে চুইয়ে নেওয়া হত। এতে সবসময় যে সফলতা আসত
তাও নয়। বরং বসন্তের বীজ অনেক সময়ই বেশি প্রবেশ করার জন্য মানুষটির রােগ হয়ে
যেত।
আসলে ঐ সময়ে ধারণা ছিল একবার বসন্ত হলে ভবিষ্যতে ঐ ব্যক্তির আর বসন্ত হবে না। ডাক্তার জেনার এই পদ্ধতির কথা জানতেন। কিন্তু অসফলতার বিষয়টিতে ছিলেন বিশেষভাবে চিন্তিত। এ সময়ে তিনি লক্ষ করেন, গাে-বসন্ত মানুষের বিশেষ কিছু ক্ষতি করতে পারে না।
তবে গাে-বসন্তে আক্রান্ত গবাদি পশুকে পরিচর্যা ও দোহনকালে গােয়ালিনীরা মৃদুভাবে আক্রান্ত হয়। তাদের হাতে দু / চারটি ফোস্কার মত গুটি বেরােয়; অন্য কোথাও ছড়িয়ে পড়ে না।
১৭৯৬ সালের ১৪ মে সাৱা নেলমস নামে এক গােয়ালিনী হাতে ফোস্কা, গায়ে ব্যথা ও জ্বর-জ্বর ভাব নিয়ে চিকিৎসার জন্য জেনারের কাছে আসে। বলে—গাছের কাটায় ছড়ে যাওয়া ক্ষতে গাইয়ের বাঁট থেকে বসন্তের গুটি রস লেগে তার ফোস্কা হয়েছে।
তার প্রিয় গাই ‘ব্লসম’ এর কিছুদিন আগে গাে-বসন্ত হয়েছিল, এ কথাও কবুল করে সে। জেনার গুটি
বসন্ত বিষয়ে সাবধান হতে বললে, সে নির্লিপ্তভাবে বলে, তার গাে-বসন্ত হয়ে গেছে তাই আর গুটি বসন্ত হবে না।
এ কথাটি জেনারকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। ভাবলেন, বিষয়টিকে পরীক্ষা করে দেখা দরকার, এ বক্তব্যের সত্যিই কোনও ভিত্তি আছে কিনা!
জেনারের এক পরিচাৱকে ৮ বছরের পুত্র জেমস ফিপস এর ওপর এক যুগান্তকারী পরীক্ষা শুরু করলেন। তখনই তিনি সারার ফোস্কা থেকে রস নিয়ে ফিস এর হাতে প্রবেশ করিয়ে দেন। ফিপস-এর আগে কখনও বসন্ত হয়নি।
কয়েকদিন পর তার ক্ষতস্থানে ফোস্কা দেখা দিল, আর কোন লক্ষণ পাওয়া গেল না। এবার জেনার সাহস করে আসল গুটি বসন্তের পুজ-রস তার শরীরে ঢুকিয়ে দেন। তারিখটা ছিল ১ জুলাই। খুবই মারাত্মক পরীক্ষা। রােগের ঝুঁকি একশাে ভাগ।
কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলেন ছেলেটি সম্পূর্ণ সুস্থ রয়ে গেল। পরবর্তীকালে এভাবে বার কয়েক বসন্তর বীজ তার শরীরে ঢুকিয়ে যখন রােগ সৃষ্টি হল না, তিনি নিশ্চিত হলেন—ফিপস এর দেহে প্রতিরােধী শক্তি গড়ে উঠেছে।
অন্যান্য অনেক ব্যক্তির মত তার ছেলের দেহেও এরকম বসন্তের বীজ ঢুকিয়ে এই বিষয়টিকে বিজ্ঞান ভিত্তি ওপর দাঁড় করান।
১৭৯৭ সালে তাঁর গবেষণালব্ধ ফল সংক্ষিপ্ত আকারে জেনার লিখে পাঠন লন্ডনের রয়্যাল সােসাইটিতে। কিন্তু তা ছাপার জন্য মনােনয়ন পেল না। তিনি হতাশ হলেন না। পরের বছর (১৭৯৮) ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার প্রকাশ করেন ও বিলি করেন।
নামকরণে ছিল ‘গুটিবসন্তের টিকা আবিষ্কার ও স্থানের উল্লেখ’। তিনটি অংশে ডা. জেনার এই লেখায় তার বক্তব্য তুলে ধরেন। প্রথম অংশে গাে-বসন্তের উৎপত্তি ও বিস্তার ব্যাখ্যা করেন। ঘােড়ার বসন্ত থেকে গাে-বসন্তের উৎপত্তি এখানে উল্লিখিত হয়, যদিও তা পরবর্তীকালে নাকচ হয়ে যায়।
দ্বিতীয় অংশে তার পরীক্ষার বিশদ বিবরণ দেন এবং তৃতীয় অংশে তুলে ধরেন গুটি বসন্তের বিভিন্ন দিক।
জেনারের এই আবিষ্কারে সারা বিশ্বে আলােড়ন সৃষ্টি হয়। প্রশংসার সাথে সাথে পেতে হয় ব্যাপক ভর্তসনা, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ও বিরূপ সমালােচনা। ব্যঙ্গ চিত্র বেরল—গরুর পুঁজ-রস নিয়ে টিকা দেওয়ায় মানুষের মুখ গরুর মত হয়েছে, মাথায় শিং গজিয়েছে।
জেনার কিন্তু নিরুৎসাহ হলেন না। মানুষের ওপর টিকার কার্যকারিতা বিষয়ে পরীক্ষা চালিয়ে যেতে
থাকেন। ধীরে ধীরে মানুষ বুঝল এই আবিষ্কারের গুরুত্ব। বসন্ত রােগে মৃত্যুর হার কমে
গেল। স্বীকৃতি এল বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে।
জেনার-এর মানবিক দিকের পরিচয় পাওয়া যায় তার বাড়ির পাশের দাতব্য চিকিৎসালয় পরিচালনার মধ্যে দিয়ে। এর নাম দিয়েছিলেন ‘টিকার মন্দির’ (টেম্পল অব ভ্যাকসিনিয়া)।

এখানে হাজার হাজার মানুষ টিকা পেয়েছেন বিনা পয়সায়। তার ব্যক্তিগত পেশাও কখনও কখনও ব্যাহত হত। এমনকি কোন কোন দিন ৩০০ মানুষকে তিনি নিজে হাতে টিকা দিয়েছে।
১৮১৫ সালে তার পত্নীর মৃত্যুতে তিনি এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন, যে পরবর্তীকালে আর জনসাধারণের সংস্রবে আসেন নি। ১৮২৩ সালের ২৬ জানুয়ারি ডা. জেনার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ল্যাটিন “ভ্যাক্কা’শব্দের অর্থ গরু। গরুর পুঁজ-রস থেকে টিকাকরণ শুরু হয়েছিল বলে তার এই যুগান্তকারী আবিষ্কারকে স্মরণীয় করে রাখতে এই আবিষ্কারের প্রায় নব্বই বছর পরে বিশিষ্ট ফরাসি বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর টিকাকরণ পদ্ধতিকে ‘ভ্যাকসিনেশন’ বলে অভিহিত করেন।
ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস সহ বিভিন্ন রােগ সৃষ্টিকারী জীবাণুদের বিরুদ্ধে আজ বিভিন্ন ভ্যাকসিন তৈরি হয়েছে। রােগ প্রতিরােধ করে আমাদেরকে মহামারীর হাত থেকে বাঁচাচ্ছে। আবার বহু মারণক্ষম ব্যাধি সৃষ্টিকারী জীবাণুকে আমরা এখনও প্রতিরােধ করতে পারিনি। তবে বিজ্ঞানীরা সারা বিশ্বব্যাপী চেষ্টা চালাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
লেখক
সিদ্ধার্থ জোয়ারদার ও অনিন্দিতা জোয়ারদার
লেখাটি গবরডাঙ্গা গবেষণা পরিষৎ থেকে প্রকাশিত
আধুনিক জীববিদ্যা ও জনস্বাস্থ্যের সহজপাঠ থেকে সংগৃহিত।