“পারলে তুমি বণিক ডেকে,
গোধূলি দাও বেচে !
গোদাবরিও শুকিয়ে যাবে,
কেউ থাকবে না বেঁচে ।”
আমাদের পৃথিবী সত্যি কি আমাদের থাকবে নাকি আমরাই আসতে আসতে সেই পৃথিবীটাকে লোভ চরিতার্থ করার লক্ষ্য বস্তু বানিয়ে বেনিয়াদের হাতে বেচে দেবো ? উত্তর আছে কি আমাদের কাছে হয়তো বলবেন আছে আবার নেই ! আস্তে আস্তে সমগ্র বিশ্ব জুড়েই জল সংকট তীব্র আকার নিচ্ছে,পানীয় জল অর্থাৎ যার উৎস ভূগর্ভস্থ জলস্তর; আস্তে আস্তে তা কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছে ।
ভারতের অন্তর্বাহিনী নদী লুনীর কথা আমাদের সকলের জানা ঠিক সীতার পাতাল প্রবেশের মতোই এক এক করে হয়তো সব নদী শুকিয়ে যাবে । তারপর শুকনো নদী খাতে হয়তো গড়ে উঠবে আকাশঝাড়ু সব ইমারত ! পুকুর চুরি প্রবাদটি সার্থক হয়েছে প্রোমোটার রাজের দৌলতে,যা পারছে ভরাট করেই চলেছে ।
সব সময়েই সমাজে উল্টো পথের কিছু মানুষ থাকেন তাঁদের বোকা,বাড়ির খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো ইত্যাদি ইত্যাদি সংজ্ঞা জোটে কিন্তু ওই মানুষ গুলো আছেন বলেই আমরা হয়তো আছি আজও ।
আচ্ছা আমাদের ধর্মীয় শাস্ত্রের সেই গঙ্গা আনার গল্পটা মনে আছে, ভগীরথের গঙ্গা আনার গল্প মনে আছে?সগর রাজার ষাট হাজার পুত্রের আত্মার মুক্তি কামনায় মর্ত্যে গঙ্গাকে এনেছিলেন ভগীরথ, যার জন্যই গঙ্গার অপর নাম ভাগীরথী। তারপর থেকে সেই গঙ্গা বয়ে চলেছে আজও।যাই হোক, এইতো গেল পুরাণের গল্প।
আজকে বলবো এমন এক মানুষের কথা বলবো,যিনি নিজের চেষ্টায় এখনো পর্যন্ত ষোলোটি পুকুর বানিয়েছেন শুধু পশুপাখিদের জল খাবার ব্যবস্থার জন্য। কর্ণাটকের মাণ্ড্য জেলায় 84বছর বয়সী এক মেষপালক ব্যক্তি নিজ চেষ্টায় এই অসাধ্য কাজ করে ফেলেছেন এবং তিনি এখনো থামেননি। তাঁর কথা অনুযায়ী,শুধু তৈরী করলেই হবে না,নিয়মিত রক্ষনাবেক্ষন অত্যন্ত আবশ্যক একটি বিষয় । তিনি শুধু পুকুর খনন করেই ক্ষান্ত হন নি, এখনো নিয়মিত সব পুকুর গুলোর দেখাশুনা করেন এবং নিজে প্রতিটি পুকুর প্রতিদিন পরিদর্শন করেন ।
পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে তিনি রাস্তা বানিয়েছেন পুকুর গুলিতে যাওয়ার জন্য এবং সেই সব রাস্তার তিনি পরিবেশ এবং জীবনদর্শন নিয়ে বিভিন্ন উক্তি লিখেছেন । পুকুরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় বাইরে থেকে ঘাস কিনে লাগিয়েছেন, নিজের নাতিদের নামে পুকুর গুলির নামাঙ্কন করেছেন l সব মিলিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে তিনি গড়ে তুলেছেন, প্রকৃতির স্বর্গরাজ্য ! যেখানে প্রকৃতি মায়ের সাথে মানুষের নিবিড় সহাবস্থান l তাঁর নিজের গ্রামে রয়েছে নয়টি পুকুর এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামে বাকি গুলি ।
তিনি নিজেই খননের কাজ করতেন ,এই কাজ করতে গিয়ে গ্রামের অধিবাসীরা তাকে ব্যঙ্গ ও করেছেন, নাম হয়েছে তার “pond-anna!” আবার অনেকে তাঁকে লেক ম্যান বা পন্ড ম্যানও বলে থাকেন l এই পুকুর গুলি তাঁর চল্লিশ বছরের পরিশ্রমের ফল ! এক অধ্যাবসার জ্বলন্ত সাক্ষ্য ! তথাকথিত অশিক্ষিত এই মানুষটি তাঁর জীবনের মাধ্যমে আমাদের পড়িয়েচলেছেন প্রকৃত শিক্ষার পাঠ ।
তিনি পেশাগত ভাবে একজন মেষপালক, চার-দশক আগে মেষ চড়াতে গিয়েই তিনি দেখেন জলের অভাবে তারা চলতে পারছে না, ঠিক করলেন এই পশুপাখিদের জন্য জলাশয় তৈরি করবেন, অনেকগুলো। একা করা সম্ভব? এটা ভেবেই দিনের পর দিন ব্যঙ্গ হতে লাগল তাকে নিয়ে। তারপর শুরু করলেন অসাধ্য সাধনের কর্মযজ্ঞ !
একা শুরু করলেন খনন কাজ ভোর 5টা থেকে শুরু করতেন প্রায় সকাল 9টা পর্যন্ত চলতো খোঁড়া খুড়ি তারপর সন্ধ্যে সাতটা পর্যন্ত জীবিকা মেষ পালন,এই ছিলো তাঁর দীর্ঘ চার-দশকের দৈনিক রুটিং । তিনি শুধু বিদ্রুপ আর ব্যাঙ্গ সহ্য করেছেন তাই নয়,তাঁর পোষা মেষ ভেড়া বিক্রি করে দিয়ে মাটি খননের জন্য কোদাল,কুড়াল ইত্যাদি ধাতব জিনিস পত্র কিনেছেন ।
কর্ণাটক রাজ্য সরকারের সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন । তাঁর প্রাপ্ত টাকা থেকে দশ থেকে পনেরো লক্ষ টাকা তিনি খরচ করেছেন এই পুকুরের কাজেই । পানাথালি আর কুন্দিনিবাট্টা এই দুটি গ্রাম কে তিনি আবার সবুজে ভরিয়ে দিয়েছেন ! পুকুরের মাধ্যমে তিনি পশু পাখি এবং মানুষের জন্য পানীয় জলের ব্যবস্থা । 84 বছরের এই মানুষটি প্রমান করেছেন,যে বয়স শুধুই সংখ্যামাত্র ! এখন তিনি খনন কার্যের জন্য বাইরে থেকে লোক অর্থাৎ শ্রমিকও নিযুক্ত করেন ব্যাক্তিগত খরচে l পন্ড আন্নার জীবন কে আমরা সকলেই কুর্নিশ জানাই ।
বয়স, দুর্বল আর্থিক পরিস্থিতি প্রতিকূল অবস্থা এবং মানুষের ঠাট্টা বিদ্রুপ কে উপেক্ষা করে লড়ছেন এই বৃদ্ধ বয়সেও তবু তিনি থামেননি, নিজেই করেছেন একা হাতে এই কাজ । জলসংকট নিবারণে অন্যতম ভূমিকা রেখেছেন তিনি।
সেই আন্না হলেন কামে গোওদা কে, যিনি এই কাজ করেছেন।অসাধ্য কে করেছেন বাস্তব , শ্রদ্ধা আপনার লড়াইকে, আপনার উদ্যমকে, আপনার চিন্তা কে যার সামনে নতজানু হতে কোনো দ্বিধা নেই!ভারতের শুধু নয় পৃথিবীর ইতিহাসে এই অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করার জন্য, পন্ড আন্না অমর হয়ে থাকবেন আর পরিবেশের জন্য তাঁর এই অবদান থেকে যাবে প্রকৃতির বুকে ! প্রকৃতি মানুষকে দান করে,এই ঘটনাই আমরা চিরোজীবন দেখে আসছি আর এই মানুষটি প্রকৃতিকেই ফিরিয়ে দিয়েছেন প্রতিদান, গর্বিত করেছেন মানব জাতি কে ।
তাই Pond আন্নার মত মানুষই হল সবুজ মানুষ।
সৌভিক রায়