এক সময় ওদের অনেক দেখা যেত। বাড়ি উঠোনে ঘুরে বেড়াত, খুটে খুটে খাবার খেত, আর কিচির
মিচির শব্দে একে অপরকে ডাকত। হ্যা, আমি চড়াই পাখির কথা বলছি। লক্ষ্য করেছেন কি এই ছােট্ট
পাখিটাকে এখন আর তেমন দেখা যায় না -বিশেষ করে শহরাঞ্চলে।
কলকাতা শহরে এক সময় প্রচুর। ‘হাড়গিলে’ পাখি দেখা যেত। এখন আর তারা নেই। হারিয়ে গেছে।
ছােট্ট চড়াইয়েরও কি একই দশা হতে চলেছে? এরাও কি বিলুপ্তির পথে? ভবিষ্যতে কি এরা শুধু বইয়ের ছবি
হয়ে থাকবে, অথবা যেতে হবে কোনাে মিউজিয়ামে?

(Passer domesticus)
শুধু চড়াই নয়, সারা পৃথিবীতে অন্যান্য অনেক পাখির সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে।নানা দেশের গণনা থেকে
জানা গেছে যে, গত ১২ বছরে চড়াইয়ের সংখ্যা প্রায় ৮০ শতাংশ কমে গেছে। এ নিয়ে অনেক আলােচনা
হচ্ছে, কিন্তু এদের রক্ষা করার জন্য তেমন কোনাে সদর্থক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানা নেই।
চড়াই এর বাসা বানানোর জায়গা নেইঃ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চড়াই হারিয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী আমাদের বদলে যাওয়া জীবনযাত্রা। ৬০-৭০ বছর আগেও আমাদের সমাজে ফ্ল্যাট বাড়ির কালচার ছিল না বললেই চলে। একতলা অথবা দোতলা বাড়ির সংখ্যাই ছিল বেশি। মাঝে মধ্যে দু-একটা তিন-চারতলা বাড়ির দেখা পাওয়া যেত।
কলকাতা শহরে এখন এত জনসমাগম ছিল না। রাস্তার তীব্র আলাের ঝলকানি ছিল না। গছপালাও ছিল বেশি। শহরে যত ভিড় বাড়তে লাগল বাসস্থানের চাহিদাও বাড়তে থাকল। গাছপালা কাটা শুরু হল, জলাভূমি ভরাট হতে লাগল, পুরানাে একতলা দোতলা বাড়িগুলি ভেঙে তৈরি হতে লাগল ফ্ল্যাট
বাড়ি। একই বাড়িতে অনেক পরিবারের বাস। অফিস কাছারি পুরানাে বাড়িগুলি ভেঙ্গে সেখানে তৈরি হল আকাশচুম্বী বাড়ি।
এখন প্রশ্ন হতে পারে বাড়ির সঙ্গে চড়াই পাখির সম্পর্ক কি? আগেকার দিনের বড়ি আর একনকার বহুতল
বাড়িগুলির মধ্যে নির্মাণ শিল্পে অনেক পার্থক্য আছে। পুরানাে বাড়ি গুলিতেো থাকা নানা ধরণের ছােট বড় ফাঁক-ফোকর, খুলখুলি, কড়ি-বড়গা, চিলেকোঠা ঘর জিনিসপত্র রাখার জন্য দেওয়ালের গায়ে তৈরি করা হত উঁচু তাক ইত্যাদি।
এগুলি চড়াই পাখির বাসা বানানাের জায়গা। সেখানে এরা ডিম পাড়ত, ছানা বড় হত। তারপর একদিন উড়ে যেত। এই দৃশ্য দেখা যেত প্রতি বছর এদের প্রজননের সময়। মানুষও এদের তেমন বিরক্ত করত না। এখনকার বাড়ি গুলি এভাবে তৈরি হয় না। কড়ি-বড়গার পরিবর্তে এখন বাড়ি তৈরি হয় ঢালাই পদ্ধতিতে। দেওয়ালগুলি হয় মসৃণ। ফলে কোনাে ফাঁক-ফোকর থাকেনা।
ঘুলঘুলি রাখার কথা তাে স্থপতিরা ভুলেই গেছে। তাই মানুষের বাসস্থান বাড়লেও চড়াইদের বাসা বানানাের জায়গা কমে যাচ্ছে। বাসাই যদি বানানাে না যায় তাহলে ডিম পাড়বে কোথায়?
চড়াই এর খাবার নেইঃ শুধুবাসা বানানাের জায়গা যে দিন দিন কমে যাচ্ছে তা নয়, খাবারেও টান পড়ছে। ছানাদের প্রধান খাদ্য পােকা। তখন তাদের বেড়ে ওঠার সময়। তাই প্রােটিনের প্রয়ােজন। চড়াই দম্পতি সারা দিন খুটে খুটে নানা জিনিস খেলেও ছানাদের খাওয়ানাের জন্য ধরে নিয়ে আসে পােকা। কীটনাশকের যথেচ্ছব্যবহারের ফলে পােকা তেমন পাওয়া যাচ্ছেনা। ফলে খাদ্য সঙ্কটে ভুগছে
চড়াই পাখিরা।
তাড়াতাড়ি বেড়ে ওঠে বলে রাস্তার ধারেই হােক বা বাগান তৈরিতেই হােক দেশি গাছের বদলে বিদেশি গাছের কদর বাড়ছে। এইসব বাহারি গাছে পােকাও ধরে কম। পােকা মাকড়ের সংখ্যা কমে যাওয়ার পরাগ মিলনে ব্যাঘাত ঘটছে। গাছে ফলন কমছে। খাদ্য সঙ্কটের এটাও আরেকটা কারণ।
শােনা যাচ্ছে মােবাইল ফোনের মূল তরঙ্গনাকি চড়াই পাখিদের অস্তিত্ব সঙ্কটের অন্যতম কারণ। এই তরঙ্গ হাজার হাজার চড়াইকে নিঃশব্দে হত্যা করছে। বিশেষজ্ঞদের এই অনুমান যদি সত্যি হয় তাহলে যে হারে মােবাইল ফোনের ব্যবহার বেড়ে চলেছে তাতে এই নিরীহ ছােট্ট পাখিটির বিলুপ্তি বেশি
দূরে নয়।
আগামী প্রজন্মের জন্য আমরা রেখে যাব একটি স্লোগান—“একদা চড়াই নামে একটা পাখি ছিল, চল তাকে দেখে আসি মিউজিয়ামে।”
তাহলে সত্যিই কি চড়াই পাখি হারিয়ে যাবে? পাখি প্রেমী পাখি বিশারদরা তা চান না। চাননি আমাদের দেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পাখিবিশারদ মহম্মদ দিলওয়ার বিগত বহু বছর ধরে চড়াই রক্ষার কাজে ব্যস্ত আছেন।
মূলত তাঁরই উদ্যোগে মার্চ মাসের ২০ তারিখকে চড়াই দিবস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে এই দিনটি বিশ্বব্যাপী চড়াই পাখি দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে—উদ্দেশ্য জনসাধারণকে সচেতন করা।
বেঙ্গালুরুর পাখি বিশারদ দিলওয়ার মত উত্তর ভারতের গাড়োয়াল হিমালয়ের উখ মঠের বাসিন্দা পাখি প্রেমি যশপাল সিং নেগি ঠিক করে ফেলেছেন যে তিনি চড়াইদের জন্য একটা বাড়ি বানাবেন। পাথরের তৈরি এই বাড়িতে থাকিবে অসংখ্য ফাঁক-ফোকর য়েখানে চড়াই পাখিরা নিশ্চিন্তে বাসা বাঁধতে পারবে।বাঁড়ির নাম হবে ‘চড়াই ভবন’। এমন উদ্যোগ ঘরে ঘরে হলে অসহায় পাখিগুলিকে আর করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে হবে না।
লেখকঃ কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়
লেখাটি বিজ্ঞান অন্বেষক এর বর্ষ ১২ সংখ্যা ৩ মে-জুন /২০১৫ থেকে সংগৃহীত।