ভারতের প্রাণী বৈচিত্র্য ঃ
ভারতীয় উপমহাদেশ প্রাণীবৈচিত্র্যে ভরপুর একথা অস্বীকার করার উপয় নেই। ভারতীয় গহন অরণ্যে বুনােকুকুর এর উপস্থিতি বন্য জীবনে এক নতুন মাত্রা যােগ করে। বুনাে কুকুর সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র বন্য প্রজাতি যাদের বাঘও ভয় পায়।



সারা পৃথিবীতে বুনাে কুকুরের মােট দুটি প্রজাতি বেঁচে আছে এক ধােল বা ভারতীয় বুনাে কুকুর আর অপরটি হল আফ্রিকার বুনােকুকুর। সর্বসাকুল্যে আফ্রিকার প্রজাতির সংখ্যা ৫০০০ এর মত হলেও ভারতীয় প্রজাতির সংখ্যা অত্যন্ত কম।
ভারতীয় বুনােকুকুরকে হিন্দিতে ধােল (সারা ভারতে প্রচলিত নাম), জংলী কুত্তা, গুজরাটিতে কোল-কুত্তা, মালয়াম ও তামিল ভাষায় চেন্নাইও কাশ্মীরে রামকূল প্রভৃতিনামেও এদের ডাকা হয়। এদেরকে এশিয়ার লালকুকুরও বলে।
বুনোকুকুর দেখতে কেমন ?
গৃহপালিত কুকুর, শেয়াল বা নেকড়ের সাথে এরাও Canidae পরিবরের সদস্য। তবে নীচের চোয়ালে ৬টা পেষক (Molar) দাঁতের উপস্থিতি বাকিদের থেকে আলাদা করে রেখেছে এদের।জায়গা বিশেষে এদের গায়ের রঙ হালকা ভারতীয় বুনােকুকুর – Dhole (Cuon alpinus) থেকে গাঢ় হয়। তবে ভারতে এদের অঞ্চলভিত্তিক তিনটে পৃথক জাতি দেখা গেছে যথা-ট্রান্স হিমালয়ান, হিমালয়ান ও পেনিনসুলার।
বুনো কুকুরবিস্তৃতিঃ—কেন্দ্রীয় ও পূর্ব এশিয়-আলতাই পর্বতমালা থেকে মাঞ্চুরিয়ান প্রদেশ এর বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলে এদের দেখতে পাওয়া যায়। উত্তরবঙ্গের তরাই ও ডুয়ার্সের বিভিন্নবনাঞ্চলে একদা স্বাভাবিক সংখ্যায় পাওয়া গেলেও ইদানিংকালে এদের সংখ্যা অস্বাভাবিক ভাবে কমে যাচ্ছে।
মধ্য ও পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন বনাঞ্চলে বিশেষ করে রাজস্থানের রনথম্ভোর জাতীয় উদ্যান, মধ্যপ্রদেশের
কানহা, বান্ধবগড় জাতীয় উদ্যান, পান্না বাঘবন ঝাড়খডের বেতলা জাতীয় উদ্যান এবং উড়িষ্যায় সিমলিপাল জাতীয় উদ্যানে এদের তুলনামূলক ভাবে বেশি করে দেখা যায়। লাদাখ ও তিব্বতে এরা মুক্ত মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়ায়।
বুনো কুকুরের স্বভাব ও বসতিঃ- এদের মাথা, দেহ ও লেজ সমেত দৈর্ঘ্য ১৩০ সেমি। উচ্চতায় এরা ৪৫-৫৫ সেমি এবং ওজনে ২০ কেজি হয়। গায়ের রঙ বাদামী। লেজ মােটা ও পুরােটাই কালো। এরাও সমাজবদ্ধ জীব। এদের সব চাইতে মুখ্য বৈশিষ্টহল দলবদ্ধ ভাবে শিকার করা। হরিণ, শুয়াের প্রভৃতি এদের প্রিয় খাদ্য। তবে দলবদ্ধ ভাবে। ভালুক, বুনাে মােষ, গাউর বাবাইসন, এমনকি বাঘকেও মেরে ফেলতে পারে বুনাে কুকুর। সত্যি বলতে বনে এরা এমনই এক প্রাণী যাদের বাঘও ভয় পায়। বুনাে কুকুর উষ্ণ আবহাওয়া পছন্দ করে।
বুনাে কুকুরের দলঃ এক একটা দলে একটি পরিবার অথবা একাধিক পরিবারের সদস্যও থাকতে পারে। এক একটা দলে ৫ থেকে ১৫টি সদস্য। থাকতে পারে (বস্তুতঃ আফ্রিকার বুনাে কুকুরের দলে সদস্য সংখ্যা হয় প্রায় ৩০-৩৫টি)।
বুনাে কুকুরের শিকারঃ সংখ্যায় যত বেশী হবে, ততবড় শিকার ধরতে পারে বুনাে কুকুর। সাধারণভাবে দিনের বেলায় শিকার ধরে। লাদাখ ও তিব্বতে এরা ভেড়া ও অ্যান্টিলােপ শিকার করে, কাশ্মীরে মারঘাের, কস্তুরী হরিণ, গােরাল প্রভৃতিকেও শিকার করে এরা।
বুনাে কুকুরের বাচ্চাঃসাধারণভাবে জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী মাসে ৪ থেকে ৬টা বাচ্চা প্রসব করে এরা।
বুনাে কুকুরের সংখ্যা কমার কারনঃ বর্তমান অবস্থা ও নগরায়ন ও উন্নয়নের সাথে সাথে বন ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাবে নিরাপদ প্রজনন স্থলের অভাবে, রেবিস ও ডিসটেম্পার প্রভৃতি সংক্রামক রােগের কারণে এবং সর্বপরি মানুষের শিকারের জন্য এরা ভীষণ ভাবে সংকটগ্রস্ত প্রাণী। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন ১৯৭২ এর তপশীল-২ তালিকাভুক্ত প্রাণী
এরা। আফ্রিকাতে পথ দূর্ঘটনাজনিত কারণে এবং হিংস্র সিংহের আক্রমণে (জায়গার অভাবে) এদের সংখ্যা ক্রমশকমে যাচ্ছে।সাম্প্রতিককালে কেম্বিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা জানিয়েছেন ‘অ্যালি প্রভাব’ (Allee effect) এর জন্য এদের সম্প্রদায়ের প্রজনন ও বৃদ্ধির হার ব্যাহত হচ্ছে।
তবে আশার আলাে দেখাচ্ছেন ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত বােতসোওয়ানা বন্য কুকুর গবেষণা প্রকল্পর (Botswana Wild Dog Research Project )গবেষকরা। একইরকম ভারতীয় বন্য কুকুরের উপরও অনুরূপ সংরক্ষণ প্রকল্পগ্রহণ করা দরকার, নইলে এই প্রজাতিটিও একদিন পৃথিবী থেকে হারিয়ে
যাবে ৷
লেখক রাজা রাউত
জলপাইগুড়ি সায়েন্স এন্ড নেচার ক্লাব
লেখাটি বিজ্ঞান অন্বেষক এর বর্ষ ১২, সংখ্যা ৩ ,মে-জুন /২০১৫ থেকে সংগৃহীত।