বাংলার নদী আন্দোলনের অপর নাম স্বপন ভৌমিক, তিনিই হলেন চূর্ণী ও মাথাভাঙা নদী বাঁচাও আন্দোলনের একাধারে সেনানায়ক আরেকাধারে সৈনিক । তাঁর জন্ম হয় নদিয়ার মাজদিয়ায় ১৯৫৬ সালের ২৯শে জানুয়ারী । তাঁর পিতা স্বর্গীয় নির্মল ভৌমিক এবং তাঁর মা ছিলেন স্বর্গীয় অঞ্জলি ভৌমিক । তাঁর বড়ো হয়ে ওঠা নদিয়ার মাজদিয়াতেই,তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয় মাজদিয়া রেলবাজার হাই স্কুল থেকে,এরপর বাণিজ্য বিভাগ নিয়ে তিনি স্থানীয় সুধীরঞ্জন লাহিড়ী মহাবিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন ।
স্বপন ভৌমিকের বসবাস এবং বেড়ে ওঠা, মাথাভাঙা, চূর্ণী ও ইছামতি এই তিন নদীর অববাহিকা অঞ্চলে । এই নদীর জীব বৈচিত্র কে রক্ষা করার জন্য তিনি যুক্ত হয়ে পড়েন পরিবেশ আন্দোলনের মূলস্রোতে ।
তাঁর এই কর্মকাণ্ডের অনুপ্রেরণা ছিলেন শ্রী সুশান্ত হালদার, যিনি বগুলার একটি স্কুলের প্রধানশিক্ষকতা করতেন এবং অস্থায়ীভাবে মাজদিয়াতে থাকতেন । আশির দশকে তিনি পরিচিত হন,প্রধান শিক্ষক মহাশয়ের সঙ্গে, তখন থেকেই তিনি যুক্ত হয়ে পড়েন এই বিপুল কর্মযজ্ঞে,ওই সময় থেকেই তিনি প্রথম লড়াই শুরু করলেন নদী অববাহিকায় বসবাসকারী; মৎসজীবিদের নিয়ে,তাদের জীবন ও জীবিকার উন্নয়নের উদ্দেশ্যে ।এছাড়াও তাঁর এই অনন্য উদ্যোগের আরেক জন অনুপ্রেরণা ছিলেন, শ্রী পান্নালাল দাসগুপ্ত,তিনি স্বপন ভৌমিকের গ্রামের গ্রামীণ সাহিত্য সম্মেলনে প্রধান অতিথি ও উদ্বোধক হিসেবে আসেন । তাঁরই পরিকল্পনায় স্বপন ভৌমিকের নেতৃত্বে শুরু হয়, মিন মঙ্গল উৎসব অর্থাৎ স্থানীয় মৎসজীবিদের মধ্যে মাছের চারা বিতরণ কর্মসূচি । সামগ্রিক ভাবে শুরু হয় ধীবর শ্রেণীর উন্নতির জন্য স্বপন ভৌমিকের সংগ্রাম,যার মূলধন ছিলো তাঁর অদম্য ইচ্ছাশক্তি এবং অনমনীয় মানসিক দৃঢ়তা ।
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে ১৯৮৭ সাল নাগাদ তিনি শুরু করেন ইছামতি নদী বাঁচাও আন্দোলন, ২০০৩ পর্যন্ত তিনি পশ্চিমবঙ্গ ইছামতি নদী সংস্কার সহায়তা কমিটির অধীনে বাংলার ইছামতি প্রবাহিত মূলত বসিরহাট,বনগাঁ,দত্তফুলিয়া, মাজদিয়া প্রভৃতি এলাকায় সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলেন । ইছামতি মানুষ সৃষ্ট এবং প্রাকৃতিক কারণে মূল মাথাভাঙার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে,এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পাড়ে ১৯৩৯-৪০ সাল নাগাদ ভারতীয় রেলের নির্মাণ কাজ নদীর নাব্যতা হ্রাসের প্রথম সূত্রপাত ঘটায় । এই সমসাময়িক সময়েই সামনে আসে মাথাভাঙা এবং চূর্ণী নদীতে শিল্প দূষণ যা নির্বিচারে ধ্বংস করছিলো ওই অঞ্চল এবং নদীর জীব বৈচিত্র ও নদীর দুপাশে বসবাস করা বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবন ও জীবিকা,এই সময় তিনি শুরু করেন চূর্ণী নদী বাঁচাও আন্দোলন । ১৯৮৫-৮৬ সালে তৈরী করেন মাথাভাঙা চূর্ণী নদী বাঁচাও কমিটি । এই কমিটির একজন দায়িত্ববান সম্পাদক হিসেবে তিনি সক্রিয় ভাবে আজও লড়ে যাচ্ছেন নদীর রক্ষায় ।
তিনি একক প্রচেষ্টায় সংযুক্ত করেছেন প্রায় ১২০টি গ্রাম,ছোটো ছোটো নৌকা নিয়ে তিনি ছুঁটে বেড়াতেন গ্রাম গুলিতে এবং ওই সব এলাকার মৎসজীবিদের মধ্যে তৈরী করতেন সার্বিক নদী সচেতনতা । তাদের উপলদ্ধি করিয়েছিলেন মানব জীবনে নদীর প্রয়োজনীয়তা । আন্তর্জাতিক সমস্যা সমাধানের জন্য বারম্বার ছুঁটে গিয়েছেন, প্রায় ১৬০০জন ধীবর জাতির মানুষদের কে নিয়ে তিনি লড়ে যাচ্ছেন দীর্ঘ চার দশক ধরে,একাধিকবার আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন । তাঁরই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবং তাঁদের আন্দোলনের ফলস্বরূপ সরকার (সরকার তরফে শেষ পাওয়া চিঠি অনুযায়ী ) এই সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়া শুরু করছেন । সমগ্র জেলার বহু শিক্ষিত যুবরা তাঁর সাথে নিয়মিত যুক্ত হচ্ছেন,এই নদী বাঁচাও আন্দোলনে । ধারাবাহিকভাবে এই এতদিন ধরে আন্দোলন পরিচালনার ফলে তিনি সাধারণ মানুষের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা গড়ে তুলেছেন ।
পেশাগত ভাবে তিনি মুদ্রণ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত,তাঁর নিজের একটি ছাপাখানা রয়েছে । দীর্ঘ ৪৭ বছর ধরে তিনি কৃষি সাহিত্য পত্রিকা নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা সম্পাদনা করে আসছেন এবং উক্ত পত্রিকার প্রকাশকও তিনিই,এই পত্রিকাই হলো তাঁদের আন্দোলনের মুখপত্র । উক্ত নামেই ২০১০ -এ তৈরী করেছেন একটি ব্লগ এবং একটি ওয়েবসাইট । ২০২০ সালের মার্চ মাসে তাঁরা তৈরী করেছেন বাংলার ইকো ক্র্যাফট নামে একটি সংগঠন,যার রাজ্য সম্পাদকের গুরু দায়িত্ব তিনি পালন করছেন । তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় থেকে সংগ্রহ করা কচুরিপানা থেকে বিভিন্ন পরিবেশ বান্ধব জিনিস তৈরির কাজ করছেন । একাধিক স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের তিনি এই কর্মসূচিতে যুক্ত করে তাঁদের আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী করে তোলার চেষ্টা করছেন । তাঁরা চেষ্টা করছেন কচুরিপানা থেকে কাগজ প্রস্তুতির, Covid-19 এর প্রকোপের কারণ তাঁদের প্রকল্প কিছুটা বিলম্বিত হয়েছে ।
২০২০ তে পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে কিছু লোভী অসাধু ব্যাবসায়ীরা, যাদের লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে কৃষ্ণনগর-মাজদিয়া ৮নং রাজ্য সড়কের দুই ধারে থাকা প্রায় ৩০০ বছরেরও অধিক পুরোনো ঐতিহ্যবাহী বৃক্ষরাশির দিকে । নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে একাধিক মহামূল্যবান গাছেদের,এর বিরুদ্ধেও সরব তিনি । এর আগে এই গাছ বাঁচানোর আন্দোলন করেছেন স্থানীয় স্কুলের শিক্ষক এবং ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে,সুসংবদ্ধ সেই আন্দোলন রুখে দিয়েছিলো নির্বিচারে বৃক্ষ ছেদন কিন্তু দ্বিতীয় বারের এই আন্দোলন নিয়ে তিনি মহামান্য কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ ।
এই পঁয়ষট্টি বছরের মানুষটির কর্ম তৎপরতা শিক্ষণীয়,এই জীবনসায়াহ্নেও তিনি সকলকে একটি সুন্দর সবুজ পৃথিবীর স্বপ্ন দেখাচ্ছেন । এখনো কিছুটা হলেও অক্ষত নদিয়ার চূর্ণী নদী ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল । তাই তো স্পর্দ্ধার নাম স্বপন ভৌমিক,অনুপ্রেরণার প্রতিশব্দ স্বপন ভৌমিক ।
লেখক
সৌভিক রায়
ভারতীয় উপ মহাদেশের পরিবেশ আন্দোলনের গবেষক ও লেখক
প্রণাম