ভারতের তথাকথিত ইতিহাস বই-এ গণিতবিদ আর্যভট্ট কিংবা রসায়নবিদ নাগার্জুনের বৈজ্ঞানিক প্রতিভার পরিচয় ছাত্র-ছাত্রীরা পায় না। কিন্তু বিজ্ঞানের ইতিহাসে ভারতের বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাসে তাদের অবদান আছে। মধ্যযুগ পর্যায়ে ভারতের ইতিহাসে বিজ্ঞান চর্চার উপর সংক্ষেপে আলােকপাত করা হল বর্তমান
নিবন্ধে।
১২০০ থেকে ১৮০০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে মধ্যযুগ বলা যেতে পারে। ত্রয়ােদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীতে ভারতে জ্যোতির্বিদ্যার চর্চা হতো। এ সময়ের বিখ্যাত জ্যোতির্বিদদের কথা জানা যায় সুলতানি যুগের ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারানির রচনা থেকে। মৌলানা হামিদউদ্দীন মতরিজ এ যুগের একজন জ্যোতির্বিদ। হাসাম নিজামি তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘তাজ-আল-মাসির’- এ রাশিচক্র, গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা করেন।
সৈয়দউদ্দিন মহম্মদ আওয়ামি তাঁর ‘জমায়েত-আল-হিকায়েত’ গ্রন্থে কম্পাস ও অ্যাস্ট্রোলেবের বর্ণনা দিয়েছেন।’সিরাত-উল-ফিরােজ শাহি’ গ্রন্থটি থেকে জানা যায়, সুলতান ফিরােজ শাহ তুঘলকের ইচ্ছায় জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে অনেক প্রবন্ধ লেখা হয়েছিল। সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ, বৃষ্টিপাতের কারণ, নক্ষত্রপুঞ্জের অবস্থান, পৃথিবীর উপর গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব বিষয়গুলি প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যা থেকে নিয়ে আবদুল আজিজ শামস স্থানেশ্বরী দালাইল একটি গ্রন্থ লেখেন।
১৭২৮ খ্রীষ্টাব্দে রাজা জয়সিংহ জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক সারণী প্রস্তুত করেন। তিনি দিল্লী, জয়পুর, উজ্জয়িনী, বারাণসী এবং মথুরায় আকাশ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন।
সে যুগে কিমিয়া বিদ্যা অর্থাৎ রসায়নের চর্চা হতাে। ধাতু দ্রবীভবন, ধাতব লবণ তৈরি, ধাতু সনাক্তকরণ, ধাতু নিষ্কাশন, সংকর ধাতু, ধাতুর রূপান্তর, অধাতুর নানা পরিবর্তন, অধাতব যৌগ গঠন, যন্ত্রের আকৃতি ও ব্যবহার পদ্ধতি, কাচ, রত্ন, ভেষজ, গন্ধ, বর্ণ প্রভৃতি বিষয়গুলি নিয়ে কিমিয়া বিদ্যা গড়ে ওঠে। রসায়নবিদ হিসাবে চক্রপানি দত্তের বিশেষ খ্যাতি ছিল।
পারদ-গন্ধক ঘটিত লবণ মারকিউরিক সালফাইড সম্ভবত তিনিই এদেশে প্রথম আবিষ্কার করেন। শাঙ্গধর রচিত ‘শাঙ্গধর সংহিতা’য় ঔষধ হিসাবে ব্যবহার্য নানারকম রাসায়নিক যৌগিক ও মিশ্রণের উপর আলােচনা করা হয়েছে। ত্রয়ােদশ শতাব্দীতে কাশ্মীরের নরহরি ‘রাজ নির্ঘণ্ট’ নামে ভেষজ শাস্ত্রের একখানি গ্রন্থ রচনা করেন। মধ্যযুগে পদার্থবিদ্যা চর্চার কথা বেশি জানা যায় না। এবিষয়ে আবুসিনার নাম উল্লেখযােগ্য।
মধ্যযুগে ইম্পাতের প্রচলন দেখা যায়। হায়দ্রাবাদের তেলেঙ্গনায়, মাদ্রাজের সালেমে এবং মহীশূরে ইস্পাত উৎপাদন হতাে। ভারতীয় ইস্পাত থেকে দামাস্কাসের তলােয়ার তৈরি হতাে। এসবের মধ্যে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির পরিচয় পাওয়া যায়। নালন্দা, বিক্রমশীলা, ওদন্তপুরী এসব বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে কারিগরী বিদ্যাও শেখানাে হতাে।
সমগ্র মধ্যযুগ জুড়ে বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনার বিকাশ সুষমভাবে হয়নি। হওয়া সম্ভবও ছিল না। মােঘল আমলে বিজ্ঞান চর্চার ভীষণ অবনতি ঘটে। সুলতানি আমলে জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিতের চর্চা হতাে। কিন্তু বিশেষ কোন মৌলিক আবিষ্কার ঘটেনি।
লেখকঃ গোবিন্দ দাস
লেখাটি বিজ্ঞান অন্বেষক এর বর্ষ-১ তৃতীয় সংখ্যা ,মে-জুন/২০০৪ থেকে সংগৃহীত।