তাঁর হৃদয়ে নদীর বসবাস,ভালোলাগা অর্থাৎ নেশা যে কিভাবে কর্মে এবং দায়িত্ব কর্তব্যে পরিণত হয়ে যেতে পারে; তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলেন অনুপ হালদার । তিনি পুরোদস্তুর নদী প্রাণ একজন মানুষ ! বাংলার “রিভার ম্যান” তিনি । অনুপ হালদারের জন্ম ১৯৮৫ সালের ২৭শে এপ্রিল,উত্তর ২৪পরগনার বনগাঁর অন্তর্গত রামপুর নামের এক ছোট্টো গ্রামে । সেই গ্রামের পাশ থেকে বয়ে যেত যমুনা,ছেলেবেলা থেকেই তাঁর এক অদ্ভুত ভালোবাসা ছিলো নদীর উপর । নদী দেখেই সময় কাটতো তাঁর,আর সেই ভালোলাগাই এখন তাঁর অবসেশন !
তাঁর পিতার নাম শ্রী দীনবন্ধু হালদার এবং মাতা হলেন শ্রীমতি বরুনা হালদার । পড়াশুনার জন্য তিনি চলে আসেন কল্যাণী তে, সেখানেই স্কুল কলেজে তাঁর শিক্ষাজীবন সম্পন্ন হয় । তিনি শারীর শিক্ষা বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করেছেন । তিনি কল্যাণীর স্প্রিংডেল স্কুলে শিক্ষকতা করেন । ২000 সালে তিনি পরিচিত হন,শ্রী জয়দেব দে এর সঙ্গে, জয়দেব দে হলেন পরিবেশ ও বিজ্ঞান আন্দোলনের পশ্চিম বঙ্গের অন্যতম নেতৃত্ব এবং কাঁচরাপাড়া বিজ্ঞান দরবার-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য । জয়দেব দে অনুপ্রেরণা এবং ছেলেবেলার সেই ভালোলাগা তাঁকে প্রভাবিত করে এবং তিনি যুক্ত হয়ে পড়েন প্রকান্ড এক কর্মসূচিতে ।
তাঁর নেশা বলতে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নদী নিয়ে গবেষণা করা,স্থানীয়স্তরে সমীক্ষা করে, নদীর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে মানুষ কে সচেতন করে তোলা । এ এক অনন্য উদ্যোগ । যেমন প্রত্যেকটি রাসায়নিক বিক্রিয়ার জন্য প্রয়োজন অনুঘটক, বা আগুন জ্বালানোর জন্য দরকার স্ফুলিঙ্গের,ঠিক তেমন রিভার ম্যান অনুপ হালদার হলেন সেই অনুঘটক । নদীগুলির সমস্যা এবং প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে তিনিই আন্দোলনকারীদের তথ্য সরবরাহ করেন যার ফলে যুক্ত পূর্ণ দাবিতে লড়াই করার কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায় । এক জন নদী বিশেষেশজ্ঞ হিসেবে তিনি শুধু খাতায় কলমে আটকে নিয়ে,স্বয়ং তৃণমূল স্তরে গিয়ে তিনি তথ্য সংগ্রহ করেন,সচক্ষে অনুসন্ধান করেন । মানুষের জীবনে নদীর ভূমিকা এবং প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তিনি সচেতনতা তৈরী করে চলেছেন নিরলস ভাবে আজ প্রায় দু-দশক । মানুষের সাথে নদীর ও প্রকৃতির আন্তঃসম্পর্কই ধরা দেয় তাঁর কাজে । বইয়ের তথাকথিত তথ্যের জালে আটকে না থেকে তিনি প্রকৃত পরিস্থিতি তুলে আনছেন,সকলের সামনে ।
মূলত নদীয়া ও উত্তর ২৪পরগনা জেলার হারিয়ে যাওয়া নদী এবং ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে প্রবেশ করা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নদী নিয়ে তিনি কাজ করছেন । নেপাল ও ভুটান থেকে বাংলায় প্রবেশ করা,নদীগুলি নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন । দীর্ঘ এক দশক ধরে তাঁরা আন্দোলন করেছেন যমুনা নদী নিয়ে, ২০১৩-১৯ পর্যন্ত তাঁদের ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলে ২০১৯-এ পশ্চিমবঙ্গ সরকার ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করে বাংলার যমুনা নদীর উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত সংস্কারের জন্য,সেই কাজ চলছে ।
২০১৮ সালে পৃথিবীর ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা ঘটে – ‘পরিবেশের জন্য মানুষের পদযাত্রা’ – পরিবেশের জন্য পরিবেশপ্রেমীদের পশ্চিমবঙ্গের টাইগার হিল থেকে সাগর দ্বীপ পর্যন্ত প্রায় ১০৭৫ কিলোমিটারের পদযাত্রা । ৩৫ দিনের এই পদযাত্রা সংগঠিত করেছিল গ্রিন ওয়াক ভাবধারার (The Green walk) পরিবেশ কর্মীরা ,এই পদযাত্রার অন্যতম একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন অনুপ হালদার । এরপরেও The Green Walk এর নেতৃত্বে তিনি একাধিক পদ যাত্রায় অংশ নিয়েছেন,পরিবেশ বাঁচানোর সংকল্পে । সেগুলির মধ্যে মাথাভাঙ্গা চূর্ণী নদীর জন্য চূর্ণী উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত পদযাত্রা,মেদিনীপুরের লালগড় ঝিটকা, শান্তিনিকেতনের গাছ ও কোপাই নদীর জন্য পদযাত্রা ইত্যাদি ছিলো অণ্যতম ।
নদী প্রেমী এই মানুষটি প্রতি সপ্তাহে তাঁর ছুটির দিন গুলিতে, শনিবার ও রবিবার বেড়িয়ে পড়েন নদীর জন্য,বাইক নিয়ে ছুঁটে বেড়ান তথ্য সংগ্রহের জন্য । অক্টোবর এবং ডিসেম্বরের দীর্ঘ ছুটি,তাঁর কাছে যেনো আশীর্বাদ । এই সময় তিনি তাঁর প্রাণের কাজ করেন । এই লম্বা সময়ে তিনি নির্বিঘ্নে তাঁর অনুসন্ধান চালান । বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তিনি নিয়মিত লেখালেখি করেন । তিনি সবুজ মঞ্চের, রাজ্যে নদী বাঁচাও কমিটির আহ্বায়কের গুরু দায়িত্ব সামলেছেন । ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে আন্তর্জাতিক স্বীকৃত নদীর সংখ্যা হলো ৫৪টি কিন্তু এছাড়াও অন্তত ১৫০টি নদী রয়েছে,বিভিন্ন অবস্থায়,হয়তো মজে গিয়েছে মানুষ সৃষ্ট বা প্রাকৃতিক কারণে তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন সেই সব নদী নিয়ে তিনি সমীক্ষা অনুসন্ধান চালাচ্ছেন এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও সরকার কে তিনি জানিয়ে চলেছেন ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ।
পর্বতসম প্রতিকূলতা সত্বেও তিনি অসাধ্য সাধনে ব্রতী হয়েছেন । নদী নিবেদিত প্রাণ অনুপ হালদার নদীকে আপন করে নিয়েছেন, স্থান দিয়েছেন হৃদয়ে । তাঁর নদী রক্ষার সংগ্রামের মাধ্যমেই রক্ষা পাচ্ছে পরিবেশ,জীববৈচিত্র এবং পরিবেশের ভারসাম্য ।
লেখক
সৌভিক রায়
ভারতীয় উপ মহাদেশের পরিবেশ আন্দোলনের গবেষক ও লেখক
পরিবেশ আন্দোলন নিয়ে আপনার আরো তথ্য দেওয়ার থাকলে আমাদের জানান । Mail – poribesnews@gmail.com
2 thoughts on “বাংলার রিভার ম্যান অনুপ হালদার”