প্রজ্ঞা মেধা এবং কর্মোময়তার এক মিশেল হলেন শ্রী সুব্রত বিশ্বাস । বাংলার সবুজ প্রকৃতির এক অতন্দ্র প্রহরী তিনি, প্রায় সাড়ে তিন দশকের বেশি সময় কাল ধরে তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের পরিবেশ আন্দোলনে ।
তাঁর জন্ম নদিয়ার শান্তিপুরে, ১৯৬৯ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর । তাঁর পিতা হলেন শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস এবং তাঁর মা শ্রীমতি কনকলতা বিশ্বাস । তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা জীবন সম্পন্ন হয়,কলকাতার ইকবালপুরের একটি স্কুল,তাঁরপর শান্তিপুর ওরিয়েন্টাল অ্যাকাডেমি এবং শান্তিপুর মিউনিসিপাল স্কুল থেকে তিনি বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন । তারপর কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে সাম্মানিক স্নাতক হন,স্নাতকোত্তর স্তরের পঠন-পাঠন চলাকালীন তিনি প্রবেশ করেন কর্ম জীবনে । ২০০৪ সালে তিনি বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ হন । ২০২০ সালে তিনি ইন্ডিয়ান ইনসিওরেন্স ইনস্টিটিউট থেকে ফেলো করছেন এবং ভারতীয় জীবন বিমা নিগমের কৃষ্ণনগর শাখার প্রশাসনিক আধিকারিক পদে আসীন আছেন ।
আশির দশকে ছাত্রাবস্থায়, অষ্টম শ্রেণীতে পড়াকালীন শ্রী সুব্রত বিশ্বাস সায়েন্স ক্লাবের সাথে পরিচিত হন এবং তাদের বিজ্ঞান কর্মসূচি তাঁকে অনুপ্রাণিত এবং উদ্বুদ্ধ করে । কৈশোরেই তিনি যুক্ত হয়ে যান বৃহদ কর্মকান্ডে, ১৯৮৮তে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় তিনি ও তাঁর বন্ধুবর অগ্রজ শ্রী বঙ্কিম চক্রবর্তী একটি সায়েন্স ফোরাম গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেন; যদিও বিভিন্ন কারণে সেই উদ্যোগ বাধাপ্রাপ্ত হলে তিনি শান্তিপুর সায়েন্স ক্লাবে যোগ দেন । এই সময় তিনি শুরু করেন বিজ্ঞান আন্দোলন,আয়োজন করেন পরিবেশ সচেতনতা মূলক বিভিন্ন কর্মসূচি,বিজ্ঞান মেলা, আয়োজন করেন পূর্ব ভারত বিজ্ঞান সম্মেলন ।
নয়ের দশকে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন, শান্তিপুরের ঐতিহ্যবাহী আম বাগান কাটা আন্দোলনে এবং বেআইনি ভাবে পুকুর ভরাটের বিরুদ্ধে গড়ে তোলেন তীব্র আন্দোলন । পরিবেশের কথা বলার জন্য ১৯৯১ সালে তৈরী করেন সবুজ কলম পত্রিকা । তাঁর নেশা বলতে লেখা লেখি,কবিতা লেখা এবং আবৃত্তি করা,বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখার পাশাপাশি তিনি সবুজ কলম এবং প্রতিবাদী চেতনায় পরিবেশ বিষয়ক কলাম লেখেন নিয়মিত । ১৯৯৪সালে তিনি বদলি হয়ে যান,তমলুকে সেখানে ফ্লাওয়ার লাভার’স অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে সম্মিলিত ভাবে পরিবেশের হিত সাধনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেন যার মধ্যে একাধিক নেচার স্টাডি ক্যাম্প-এর আয়োজন উল্লেখযোগ্য ।
কর্মসূত্রে পাণ্ডুয়াতে থাকাকালীন,২০০২ সালে তিনি ওই অঞ্চলের প্রসিদ্ধ মিনার সংলগ্ন মাঠে এক বৃহদ বৃক্ষ রোপন কর্মসূচি পালন করেন, এরপর পূর্ব বর্ধমানের কালনায় গড়ে তোলেন বিজ্ঞান ও সচেতনতা আন্দোলন । ২০০৪ সালে পুনরায় তিনি শান্তিপুর সায়েন্স ক্লাবের সম্পাদকের গুরু দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন, প্রায় এক দশকে প্রকাশিত বিভিন্ন পরিবেশ বিষয়ক প্রবন্ধ নিয়ে তিনি বিপন্ন প্রকৃতি শিরোনামে এক প্রবন্ধ সংকলন সম্পাদনা করেন,যা পরিবেশের একটি অন্যতম সংগ্রহযোগ্য মূল্যবান গ্রন্থ । তারপর নবদ্বীপে পড়শী পত্রিকা ও সংগঠন এবং সময় পত্রিকা তৈরী করে সেখানেও পরিবেশ আন্দোলনের ঢেউ পৌঁছে দেন, ২০০৯ সালে হুগলি জেলার চুঁচুড়াতে থাকাকালীন তিনি একাধিক বিজ্ঞান ও পরিবেশ নিয়ে কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন,ইউ & আই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে তিনি পরিবেশ বিষয়ক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নেন ।
২০১৬ সালে তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যার স্মৃতির উদ্দেশ্যে তৈরী করেন, সেঁজুতি প্রকৃতি বিদ্যাশ্রম যার মূলউদ্দেশ্য প্রাকৃতিকর কোলে পঠন পাঠন । বন পার্বন নামে একটি মহতী কর্মসূচীতে তাঁর যোগদান আলাদা মাত্রা এনে দেয় , ২০টি পরিবেশ পন্থী সংগঠনকে ১০০০ টি চারা গাছ বিতরণ বিতরন করা হয় । এই কর্ম কাণ্ডের অধীনে তাঁরা আরেকটি অভিনব উদ্যোগ নেন, বৃক্ষ দত্তক – ১০০টি চারা গাছ টবে লাগিয়ে পরিজনের স্মৃতিতে বিতরণ করা হয় । তিনি নিজে স্বয়ং প্রতি বছর একাধিক বৃক্ষ রোপন করেন ।
২০১৭ সালে প্রায় ৪২টি সংগঠন মিলিত হয়ে তৈরী হয় নদিয়ার পরিবেশ ভাবনা মঞ্চ,যার সভাপতির দায়িত্ব সামলাচ্ছেন সুব্রত বিশ্বাস নিজেই । এই পরিবেশ ভাবনা মঞ্চের মাধ্যমে তিনি বাগান কাঁটা ও পুকুর ভরাটের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে যাচ্ছেন । শব্দ দূষণ এবং ডিজের বাড়বাড়ন্তের বিরুদ্ধেও তিনি আন্দোলন করেছেন ।
২০১৮ সালে The Green walk পন্থী পরিবেশ কর্মীরা অসাধ্য সাধন করেন যা পৃথিবীর ইতিহাসের বিরলতম ঘটনা , পরিবেশের জন্য মানুষের পদযাত্রা । পরিবেশের জন্য ১০৭৫ কিলো মিটার পথ পায়ে হেঁটে অতিক্রম করেন পশ্চিমবঙ্গের পরিবেশপ্রেমীরা । টাইগার হিল থেকে সাগরদ্বীপ পর্যন্ত এই পদযাত্রার অন্যতম সক্রিয় সদস্য ছিলেন সুব্রত বিশ্বাস । পরবর্তীতে দ্য গ্রিন ওয়াক (The green walk) আয়োজিত একাধিক পদযাত্রায় তিনি অংশ নেন । ২০১৯ সালে তিনি আমেদাবাদে, ভারত সরকারের বিজ্ঞানপ্রসার দপ্তরের সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করেন এবং মধ্যপ্রদেশে জাতীয় জল সন্মেলনে যোগ দেন এবং তিনি উক্ত বিষয়ের ড্রাফটিং কমিটির একজন সদস্য হিসেবে কাজ করেন ।
২০২০ সাল পর্যন্ত তিনি কাজ করে চলেছেন পরিবেশের স্বার্থে, এতো কর্মতৎপর তিনি এবং কর্ম মুখর তাঁর এই দীর্ঘ পরিবেশ সংগামী জীবন বহু মানুষের অনুপ্রেরণা । তাঁর সুদক্ষ নেতৃত্ব এবং সুসংবদ্ধ আন্দোলন সমৃদ্ধ করেছে বাংলার পরিবেশ আন্দোলনের ইতিহাস কে, বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছে তাঁর পরিবেশ চেতনা ।
লেখক
সৌভিক রায়
ভারতীয় উপ মহাদেশের পরিবেশ আন্দোলনের গবেষক ও লেখক
পরিবেশ আন্দোলন নিয়ে আপনার আরো তথ্য দেওয়ার থাকলে আমাদের জানান । Mail – poribesnews@gmail.com
যে কোন কাজে এমন নিবেদিত প্রাণ সচরাচর দেখা যায় না । আর নদী হলে তো কথাই নেই।
বাংলার নদী মানেই অনুপ। যথার্থ উপাধি ‘রিভার ম্যান’