শুরু থেকেই শুরু করছি। খ্রীস্টপূর্ব ৫৮৫, আজ থেকে বহু বছর আগে। ‘বিজ্ঞানের জন্মদিনের’ কথা দিয়ে শুরু করছি। ওই বছরের আঠাশে মে তারিখে তুর্কি দেশের মিলেটাস শহরে দারুণ সােরগোল পড়ে গেল।
ছেলেবুড়াে সবাই রাস্তায়, ফাঁকা মাঠে ভিড় করতে লাগল, সবাই হা করে তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে, কারণটা কি? আসলে, ‘হ্যালিম’ নামে একজন পণ্ডিত আগে থেকেই জানিয়ে দিয়েছেন, আজ এই শহর থেকে সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে। সেদিন সত্যিই ঐ শহর থেকে সূর্যগ্রহণ দেখা গেল।
এই দিনটিই ‘বিজ্ঞানের প্রকৃত জন্মদিন’। ঐ দিন প্রথম সূর্যগ্রহণ হল তা কিন্তু নয়। সূর্যগ্রহণ আগেও হত। তবে এই প্রথম আগাম সূর্যগ্রহণের খবর সকলের জানা ছিল। এবং সকলেই সানন্দে তা চাক্ষুস করেছে।
ইতিপূর্বে যখন সূর্যগ্রহণ হত, পুরােহিতেরা ব্যাখ্যা করতেন ‘গ্রহণ আসলে দেবতা বা অপদেবতার কাণ্ড’।
সে জন্য শাখ-ঘণ্টা-কাঁসর বাজিয়ে, পূজো করে, মন্ত্র পড়ে দেবতাকে খুশী করা হত। আসলে, থ্যালিস সূর্যগ্রহণকে ব্যাখ্যা করেছেন একটি প্রাকৃতিক (লৌকিক) ঘটনা হিসাবে, অলৌকিকতা, কুসংসারের কোন ছাপ এর মধ্যে ফেলেনি। থ্যালিস বহু শতাব্দী আগে। সূর্যগ্রহণের কারণ সহ ব্যাখ্যা খুঁজে লৌকিক ঘটনা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেও এখনও সূর্যগ্রহণ নিয়ে বহু অলৌকিক ব্যাখ্যা প্রচলিত।
সূর্যগ্রহণ নিয়ে উদাহরণ দেওয়া হল, এমন বহু প্রাকৃতিক ঘটনার পেছনে বিজ্ঞানসম্মত কারণ থাকলেও কুসংসস্কারের মােড়কে জনমানসে প্রচলিত অজ্ঞানতা যেমন কুসংস্কারের একটি কারণ, তেমন শাসক (রাজা, পুরােহিত, সম্রাট প্রভৃতি) প্রতাপ টিকেয়ে রাখাও কুসংস্কার টিকে থাকার আর একটি কারণ। যেমন ধরা যাক, মিশরের পিরামিড, পিরামিডের কোনাে কোন একখানা পাথরের ওজন নাকি ৩৫০০-৩৬০০ কুইন্টাল।
গ্রীক ঐতিহাসিক হেরােডেটাস বলেছেন পিরামিড তৈরির জন্য যা পাথর লেগেছে, পাহাড় থেকে সেই পাথর কাটার জন্য এক লক্ষ মানুষকে দশ বছর একটানা পরিশ্রম করতে হয়েছে। তারপর কত পথ পার করে এনে পিরামিড গাঁথা, তার ভেতরে সুখে জীবনযাপন করার জন্য সবরকম প্রয়ােজনীয় সামগ্রী।
এতবড় পিরামিড, তার ভেতরে এত বিলাসসামগ্রী এই সবকিছুই মারা যাওয়া রাজার আমােদের জন্য
যা সম্পূর্ণ অবাস্তব। তবুও কুসংস্কারের কারণে এতবড় কাজ করা যেত। লক্ষাধিক লােক নিযুক্ত থাকত এরকম একটা ভিত্তিহীন কর্মকাণ্ডে সবটাই অজ্ঞানতার দাপটে চলত।
তৎকালীন সময়ে অনেক পুরােহিত খুব প্রতিভার অধিকারী ছিল, তারা বেশ কিছু আবিষ্কারেও তাদের ছাপ ছিল –– কিন্তু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি তাদের ছিল না। শাসক দলের ঠিক ভাবে শাসনকার্য চালানাের জন্য কুসংস্কার টিকিয়ে রাখা তাদের অতি প্রয়ােজনীয় সেজন্য তারা বিজ্ঞানকে প্রশ্রয় দিতে পারে না।
আমাদের সমাজে এখনও কুসংস্কার টিকে থাকার প্রধান বা অন্যতম কারণ অজ্ঞানতা বা বিজ্ঞান মনস্কতার অভাব।
এখন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরীক্ষাগার রয়েছে, আবিষ্কৃত হয়েছে বিজ্ঞানের অনেকগুলি শাখা। প্রতিনিয়ত চলছে গবেষণা, হচ্ছে আবিস্কার। সভ্যতা হচ্ছে উন্নত থেকে উন্নততর। গােটা পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়, মুহূর্তেই বিশ্বের যে কোনও জায়গার সাথে যােগাযােগ সবই সম্ভব এখন বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য, বিজ্ঞানের আবিষ্কারের জন্য। তবু বর্তমান সভ্যতা কুসংস্কার মুক্ত নয়।
প্রচলিত কিছু কুসংস্কার : প্রযুক্তি বিজ্ঞানের দান দ্রুতগামী ট্রাক বা যেকোন মােটর গাড়ি এইসব গাড়ি চলার সময় সামনে বিড়াল চলে গেলে চালক গাড়ি থামিয়ে দেয়। কারণ, দূর্ঘটনা এড়ানাে। কিন্তু বিজ্ঞানের যাওয়ার সাথে দূর্ঘটনার কোনও সম্পর্ক নেই। বরং কুসংস্কারের বশে হঠাৎ দেখা বিড়ালের জন্য ব্রেক করতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
পিছনে ডাকলে, যে কাজে বের হচ্ছে তা ব্যর্থ হয়। উদাহরণস্বরূপ সুমিতবাবু কাঁচরাপাড়া থেকে নৈহাটি যাবেন একটি ব্যাঙ্কের নৈহাটি শাখায় টাকা তােলার জন্য। বের হওয়ার সময় সুমিতবাবুর ছেলে পিছনে ডাক দিল। তবুও সুমিতবাবু বের হলেন। কাঁচরাপাড়া স্টেশনে পৌছে দেখলেন বিশেষ কারণে সকাল সাড়ে দশটা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত রেল অবরােধ চলছে।
অগত্যা বাড়ি ফেরা এবং ব্যাঙ্কে টাকা তুলতে পারার কারণ হিসেবে ছেলেকে দায়ী করা। কিন্তু এখানে উদাহরণ থেকে পরিস্কার যে ব্যাঙ্কে টাকা তুলতে না পারার জন্য দায়ী ট্রেন অবরােধ।
টিকটিকির টিকটিক শব্দে যাচাই করা হয়। কোন কথা বলার পরেই যদি টিকটিকি টিকটিক করে ওঠে তবে সেই কথাটা অবশ্যই সত্যি বলে প্রমাণিত হয়। কিন্তু কথার সত্যতার সাথে টিকটিকির টিকটিক করার
কোনও সম্পর্ক নেই। প্রথমত, এই শব্দ টিকটিকির একটি জৈবিক ক্রিয়া, দ্বিতীয়ত, টিকটিকির মানুষের কথা বােঝার মত ক্ষমতা নেই।
সকাল-সন্ধ্যে পূজা করে শাঁখ বাজালে, শাঁখের আওয়াজে জীবাণু ধ্বংস হয়। শাঁখের আওয়াজে কখনই জীবাণু ধ্বংস হতে পারে না। শখের আওয়াজে শব্দের কম্পাঙ্ক 20 HZ-2000 Hz. এবং যে শব্দে জীবাণু
ধ্বংস হতে পারে তা হল আলট্রাসনিক সাউন্ড যার কম্পাঙ্ক 20000 Hz থেকে 1000000 Hz. সুতরাং শাঁখের শব্দ কখনই আলট্রাসনিক সাউন্ড নয়, তাই জীবাণু ধ্বংসের কোনও সম্ভাবনা নেই।
এরকম অসংখ্য কুসংস্কার এখনও সমাজে টিকে আছে। অথচ বিজ্ঞান আজ উন্নতির শিখরে বিরাজ করছে। বিজ্ঞান মনস্কতা, বিজ্ঞান জনপ্রিয়তা,সকলের মধ্যে বিজ্ঞান চেতনা গড়ে তােলার সুব্যবস্থা অবিলম্বে (যত তাড়াতাড়ি সম্ভব) করা প্রয়ােজন।
বিজ্ঞান অন্বেষক এর জুলাই আগষ্ট ২০০৭ থেকে সংগৃহীত।