আঙুর সুস্বাদু রসালাে ফল হিসাব পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র পরিচিত। আঙুর সর্বপ্রথম বিদেশ থেকে ভারতে আসে।পূর্বে সযত্নে তুলার আধারে আঙুর আমদানি করা হতাে। পশ্চিম এশিয়া, দক্ষিণ ইউরােপ, আলজিরিয়া এবং মরক্কোর নাতিশীতােষ্ণ অঞ্চলে। আঙুর হয় কাস্পিয়ান সাগর ও ককেশাস পর্বতমালার দক্ষিণে। এবং বিশেষ করে আর্মেনিয়ার গ্রীষ্মমণ্ডলে আঙুরের লতানাে গাছ জন্মায়।
লতা ছাঁটাই করে দিলে। প্রচুর পরিমাণে ফলন হয়। কাশ্মীর,কাবুল, এমনকি হিন্দুকুশের উত্তরেও অবাধে আঙুর জন্মাবার কথা উল্লিখিত আছে। ইউরােপম ও এশিয়াতেও মানুষের বসতির পূর্বেই পশু-পাখির সাহায্যে আঙুর বিস্তার লাভ করেছিল। সেমিটিক জাতি ও আর্যরা আঙুর বা দ্রাক্ষা হতে উৎপন্ন সুরার ব্যবহার জানত এবং খুব সম্ভব দেশত্যাগ করে ভারতবর্ষ, মিশর ও ইউরােপের যেসকল দেশে তারা নতুন বসতি স্থাপন করেছিল, সেখানে আঙুর চাষেরও চলন করে।
মিশরে প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার বছর পূর্ব থেকে আঙুর চাষের প্রচলন ছিল। কিন্তু পূর্ব এশিয়ায় এর বিস্তার লাভ ঘটে অনেক পরে। হয়তাে সুরাসক্ত ভারত বিজয়ীরাই এ দেশে আঙুর চাষের প্রথম প্রচলন করে। দেশ বিভাগের পূর্বে আঙুরের উৎপাদন আমাদের দেশে প্রয়ােজন মতাে ছিল, কেননা বেলুচিস্থান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশেই এর চাষ ব্যাপকভাবে বিস্তৃত ছিল।।
এছাড়াও কিশমিশ-মনাক্কা বরাবরই আফগানিস্তান থেকে আমদানি করা হত। বর্তমানে হায়দরাবাদ, মহারাষ্ট্র, মাদ্রাজ এবং মহীশূরে প্রধানত এর চাষ হয়ে থাকে, যদিও ভারতের বহু স্থানে চাষ বৃদ্ধি করা সম্ভবপর। উর্বরা সরস মাটি, দোআঁশ পাথুরে মাটি এবং জলনিকাশী জমি আঙুর চাষের উপযােগী।
সামান্যতম বৃষ্টি অর্থাৎ যেসব অঞ্চলে বৃষ্টি ২০-২৫ সেন্টিমিটার মাত্র, সেখানেও এর পূর্বেই যাতে ফল পাকে সেইসকল জাতীয় আঙুরই সাফল্যের সঙ্গে চাষ করা চলে। ভারতে বর্তমানে আনাব-ই-শাহী আঙুরই সর্বোৎকৃষ্ট বলে প্রসিদ্ধ এবং এর চাষ ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছে। প্রচুর ফলন এবং লাভের দরুণ এর
উৎপত্তির স্থান হায়দরাবাদ থেকে দ্রুত সমস্ত দক্ষিণ ভারতে, এমনকি মহারাষ্ট্রেও প্রসার লাভ করেছে।
এক একর চাষ করে ১০-১২ হাজার টাকার আঙুর বিক্রয় সম্ভব। এছাড়াও বোখরী, কান্দাহারী, কালাে সমকট ইত্যাদিও সাফল্যের সঙ্গে বিভিন্ন অঞ্চলে চাষ করা যায়। দিল্লী ও পাঞ্জাবেও আঙুরের চাষ প্রসার লাভ করেছে। হিমাচল প্রদেশে কিশমিশের উপযােগী আঙুর চাষের প্রচেষ্টা সাফল্য পেয়েছে। পশ্চিম বাংলায় এই অঞ্চলের উপযােগী আঙুরের অনুসন্ধান চলছে এবং কিছুটা সাফল্য লাভ করা গেছে।
আঙুরের পুরােনাে ডাল কেটে মাটিতে বসিয়ে নতুন চারা উৎপাদন করা হয়। এক বছরের পুরােনাে কাটিং ৬-৭ হাত অন্তর গর্তে, বসানাে হয়। গাছ মাটিতে লেগে যাওয়ার পর গ্রীষ্মকালে আগাছামুক্ত করে সেচ
দেওয়া উচিত। আঙুরের লতা সাধারণতঃ কংক্রিটের অথবা লােহার স্থায়ী মাচানের উপর উঠিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে লতা ছাঁটাই করতে হয়, যাতে নতুন লতা বের
হয়ে ফুল ও ফল ধরে।
রােগ দমন একটি প্রধান কাজ এবং সর্বত্রই ‘বাের্দো’ মিশ্রণ ধারাবাহিক ভাবে সিঞ্চন করা হয়। পােকা দমনের জন্য একইসঙ্গে খােলা ডি ডি টি সিঞ্চন করা হয়। সম্পূর্ণ পাকবার পরই গাছ থেকে আঙুর
তােলা হয়, কারণ তােলার পর অন্য ফলের মতাে আঙুরের মিষ্টত্ব ও স্বাদের কোনও উন্নতি হয় না। বিভিন্ন জাতির আঙুরের পাকবার সময় বিভিন্ন এবং রঙ ও স্বাদ বিভিন্ন হয়ে থাকে। ফলের থােকা কাচি বা
ধারালাে ছুরি দিয়ে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে কেটে সযত্নে ঝুড়ির নীচে কিছু ঘাস-পাতা বিছিয়ে তার মধ্যে রাখা উচিত। কাচা, বেশি পাকা বা ক্ষতিগ্রস্ত ফল ফেলে ভালাে ফল ঝুড়িতে বা কাঠের বাক্সে রাখতে হবে।
প্রথম দিকে ফলন একর প্রতি ২-৩ হাজার কিলােগ্রাম হলেও ক্রমে গড়পড়তা ফলন প্রায় ৫ হাজার কিলােগ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। বর্তমানে ফুল ফোটার পর জিব্বারেলিক অ্যাসিড প্রয়ােগ করে, অল্প ব্যয়ে ফলন প্রভূত পরিমাণে বাড়ানাে সম্ভব হয়েছে। জিব্বারেলিক অ্যাসিড, পেনিসিলিনের মতােই ধানগাছ আক্রমণকারী ছত্রাক ‘জিব্বারেলিক অ্যাসিড ৫০ পি পি এম প্রয়ােগেই ভালাে ফলন পাওয়া যায়। এই
মাত্রার প্রয়ােগ মানুষ বা অন্য কারও পক্ষে ক্ষতিকারক নয়।
—শৈবাল কুমার গুহ