গাছকে জড়িয়ে ধরে যারা কাঁদে, তারা টের পায়—
মানুষ অনেক পরে,
উদ্ভিদ প্রথম প্রাণ…
উদ্ভিদ প্রথম প্রাণ…হে মানুষ! মাফিয়া মানুষ!
তুমি তো নিশ্চিহ্ন হবেহাতে মাত্র কিছুকাল আছে
সূর্যাস্তে দাঁড়াও! দ্যাখো
পাখিরা ঠোটের রক্ত মুছে দিচ্ছে যেন
যশোর রোডের গাছে গাছে…
– কবি বিভাস রায়চৌধুরী
আজকের একবিংশ শতক হল সবুজের শতক, এই সবুজ শতকের সবুজ কবি হলেন শ্রী বিভাস রায়চৌধুরী । তাঁর একাধিক পরিচয় তিনি কবি, ঔপন্যাসিক , প্রাবন্ধিক এবং নাট্যব্যক্তিত্ব । এই সব পরিচয়ের বাইরে তিনি হলেন একজন দার্শনিক, যে দর্শন পরিবেশকে ভালবাসতে শেখায়, সবুজকে উপলব্ধি করতে শেখায়, তাদের ব্যথা অনুভব করতে শেখায় । তাই তাঁর কলম হয়ে ওঠে সবুজের ভাষা, সবুজের কন্ঠ। বলে যায় গাছেদের না বলা কথা ।
এই শতকের অন্যতম প্রথিতযশা কবি হলেন শ্রী বিভাস রায়চৌধুরী, পশ্চিমবাংলার প্রান্তিক শহর বনগাঁর বিহুতিপল্লীতে তাঁর জন্ম হয় ১৯৬৮ সালের ১লা অগাস্ট । তাঁর পিতা শ্রীযুক্ত শ্যামদুলাল রায়চৌধুরী এবং তাঁর মা হলেন শ্রীমতি বীথিকা রায়চৌধুরী । তাঁর স্কুলশিক্ষা জীবন সম্পন্ন হয় বনগাঁ উচ্চ বিদ্যালয়ে, এরপর তিনি গোবরডাঙ্গা হিন্দু কলেজ থেকে স্নাতক হন। প্রকৃতির সাথে শিশুকাল থেকেই নিবিড় যোগাযোগ, তাঁর বেড়ে ওঠা প্রকৃতির কোলেই । শৈশবকাল থেকেই সঙ্গীত, নাটক এবং কবিতার প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ ।
ছাত্রাবস্থায় তাঁর শিক্ষক শ্রী ঊষাপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের কাছে কবিতার হাতে খড়ি। পরবর্তীতে পরামর্শদাতা রূপে পেয়েছিলেন কবি বিনয় মজুমদার কে, আশির দশক থেকে তিনি নিয়মিতভাবে বিভিন্ন বিখ্যাত পত্র পত্রিকায় লিখছেন । যার মধ্যে দেশ, কৃত্তিবাস, দৈনিক বসুমতী উল্লেখযোগ্য ।
সাহিত্য জগতের এই নক্ষত্রের একাধিক মহামূল্যবান সৃষ্টি রয়েছে, যার মধ্যে ‘নষ্ট প্রজন্মের ভাসান’ ( তাঁর প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ , যা ১৯৯৬ সালের কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় প্রকাশিত হয় ) ‘উদ্বাস্তু শিবিরের পাখি’, ‘শিমুলভাষা পলাশভাষা’, ‘জীবনানন্দের মেয়ে’, ‘যখন ব্রিজ পেরোচ্ছে বনগাঁ লোকাল’, ‘চন্ডালিকাগাছ’, ‘পরজন্মের জন্য স্বীকারোক্তি’, ‘সমস্ত দুঃখীকে আজ’, শ্রেষ্ঠ কবিতা, ‘আমার সামান্য দাউদাউ’, ‘অনন্ত আশ্রম’ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ উল্লেখযোগ্য । তাঁর প্রকাশিত উপন্যাস গুলি হল ‘কলাপাতার বাঁশি’, ‘অশ্রুডানা’, ‘বাইশে শ্রাবণ’ ইত্যাদি । তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘অশ্রুধারা’ ২০০২ সালের ৪ ঠা নভেম্বর ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় l সাহিত্যে তাঁর অনন্য কীর্তির জন্য তিনি পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার, ১৯৯৭ সালে কৃত্তিবাস পুরস্কার , বাংলা আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন ২০১৩ সালে। নির্মল আচার্য স্বর্ণপদক পেয়েছেন ।
তাঁর কয়েকটি কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন সুপরিচিত কবি ও অনুবাদক ডঃ কিরীটী সেনগুপ্ত। হাওয়াকল পাবলিশার্স (কলকাতা) এর সহযোগিতায় ইনার চাইল্ড প্রেস (নিউ জার্সি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) ২০১৪ সালে প্রকাশ করেছে ‘পোয়েম কন্টিনিউয়াস : রিইনকারনেটেড এক্সপ্রেশন’ ।
তিনি ‘কবিতা আশ্রম’ নামে বাংলা সাহিত্য পত্রিকার অন্যতম প্রধান উপদেষ্টা এবং পেশাগতভাবে একটি প্রকাশনা সংস্থায় কর্মরত ।
‘পরিবেশ আন্দোলন’ এই শব্দবন্ধটি বহু প্রাচীন কোনো শব্দ নয়, গত দশক থেকেই এই শব্দটি বহু চর্চিত হচ্ছে । পৃথিবীর কেউই নিরপেক্ষ নন, পরিবেশকর্মীরা তো নিরপেক্ষ নয়ই। তাঁরা হলেন পরিবেশের পক্ষে ; যার আলাদা করে কোনো দল বা পক্ষের প্রয়োজন নেই । পরিবেশের ব্যথা, যন্ত্রণা হল তাঁদের যন্ত্রণা, তাঁদের ব্যথা । বাংলার পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের এই মূল দর্শনটি তাঁরই চিন্তনের ফসল ।
সবুজ কবি বিভাস রায়চৌধুরী সময়কে অস্বীকার করেননি । প্রতিনিয়ত পরিবেশ ধ্বংসের ফলস্বরূপ বিশ্ব উষ্ণায়ণ যেখানে এই সময়ের প্রধান ইস্যু , সেখানে তার কলম , তার সাহিত্য সৃষ্টি হয়ে উঠেছে পরিবেশের একেবারে নিজের পক্ষ – নিজের কলম । মিথ্যা উন্নয়নের স্বপ্নে বিভোর হয়ে ওঠা মানুষ যখন যশোর রোডের হাজার হাজার গাছ কাটতে বদ্ধপরিকর, সবুজ কবি বিভাস রায়চৌধুরী হয়ে উঠলেন গাছেদের ভাষা । যুক্ত হয়ে পড়লেন ‘যশোর রোড গাছ বাঁচাও আন্দোলনে’ । হাঁটলেন গাছেদের জন্য, একবার নয় একাধিকবার । দুই বাংলার প্রাকৃতিক সম্পদ যশোর রোডের প্রায় পাঁচ হাজার শতবর্ষীয় গাছ বাঁচাতে , বনগাঁ থেকে বারাসাত প্রায় ৫৩ কিলোমিটার দীর্ঘ পদযাত্রায় তিনি অংশ নেন । তার পথ নাটিকা মাধ্যম হয়ে উঠেছে পরিবেশ সচেতনতার । তাঁর কলম সৃষ্টি করেছে ‘যশোর রোডের গাছ’ নামের একটি কাব্যগ্রন্থ, যা হয়ে উঠেছে বর্তমান শতাব্দীর একমাত্র পরিবেশ বিষয়ক মহাকাব্য গ্রন্থ, যেখানে তিনি তাঁর রচনার প্রতি ছত্রে গাছেদের কথা বলেছেন, সবুজ পৃথিবীর প্রয়োজনীয়তা, সবুজ ধ্বংসের অশনি সংকেত, মানুষের পরিণতি এবং পরিবেশযোদ্ধাদের কথা ধরা দিয়েছে তাঁর শব্দে ছন্দে । যেখানে পৃথিবীর সব রাস্তাই যশোর রোড । আর সব গাছই যশোর রোডের গাছ ।
২০১৭ সালে যশোর রোডের গাছ বাঁচাও আন্দোলন শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই তিনি গাছেদের জন্য কলম ধরেছেন । তার কলম তার বাড়ির সামনের বনগাঁ-চাকদহ রোডের গাছ বাঁচাতেও কান্নায় সিক্ত হয়েছে । লিখছেন বিভিন্ন রূপকাশ্রয়ী পথনাটিকা ও পূর্ণাঙ্গ নাটক। প্রাক যশোর রোড আন্দোলন সময়কালে তিনি বনগাঁ নাট্যচর্চা কেন্দ্রের মাধ্যমে ‘আসল হইতে সাবধান’ শীর্ষক অমিত কুমার বিশ্বাস রচিত একটি নাটক মঞ্চস্থ করেন শিশুদের নিয়ে, এই নাটকের মাধ্যমে তিনি বিপদগ্রস্থ পরিবেশের অশনি সংকেত বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন বারবার ।
পৃথিবীর অনেক কবিরই কবিতায় , কাব্যগ্রন্থে পরিবেশ বারবার এসেছে – এসেছে গাছ , নদী , পাহাড়, জঙ্গলের কথা , কিন্তু তাঁরা কেউই সবুজ কবি হয়ে উঠতে পারেননি । কারন তাদের সাহিত্য ছিল শুধুমাত্র প্রকৃতি প্রেম – প্রকৃতি রোমাণ্টিকতাজাত । কবি বিভাস রায়চৌধুরীর সাহিত্য সৃষ্টিতে সচেতনভাবে প্রকৃতির সমস্যাগুলি এসেছে , বিশ্ব উষ্ণায়নের দানবকে তিনি পরিপূর্ণভাবে চিহ্নিত করেছেন । প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংসের কারনকে শুধু তুলে আনা নয় তার সমাধানের পথও তার কাব্যের বিষয় । তিনি তার সবুজ কাব্যের জন্য পরিবেশকর্মীদের কাছে পিতা হয়ে উঠেছেন । দর্শন ছাড়া কোন আন্দোলন জমাট বাঁধতে পারে না, সবুজ কবি যে পরিবেশপন্থী দর্শনকে তুলে এনেছেন তা হয়ে উঠেছে এই শতাব্দীতে পশ্চিম বাংলার পরিবেশ আন্দোলনের মূল মন্ত্র ।
২০১৮ সালে বাংলার ঐতিহাসিক পরিবেশের জন্য মানুষের পদযাত্রায় (১০৭৫ কিলোমিটার পদযাত্রা) কবি বিভাস রায়চৌধুরী অংশ নেন। ৩৫ দিন ব্যাপী পাহাড় থেকে সাগর এই পদযাত্রা আয়োজন করেছিল ‘দ্য গ্রিন ওয়াক’ ( The Green walk ) পন্থী ভাবধারার পরিবেশকর্মীরা, পৃথিবীর ইতিহাসে এটা ছিল একটি বিরলতম ঘটনা ।
বর্তমানে সবুজ কবি শ্রী বিভাস রায়চৌধুরী, তাঁর পরিবেশ উপলব্ধির মূল ভাবধারার উপর ভিত্তি করেই লিখছেন । তাঁর পরিবেশ চেতনার নির্যাস পাওয়া যায় তাঁর লেখা কবিতা গুলিতে, যেখানে উঠে এসেছে সহনাগরিক গাছেদের প্রতি আক্রমণের কথা, পরিবেশ রক্ষকদের সংগ্রামের কথা, ব্যথার কথা – এইখানেই তিনি হয়ে উঠেছেন সবুজ কবি । শ্রী বিভাস রায়চৌধুরী কবি বিভাস রায়চৌধুরী ও তাঁর কলমের প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছেন , তাঁর বাকি স্রষ্টা জীবন তিনি সবুজের জন্যই লিখবেন এবং সবুজের কথা পৌঁছে দেবেন মানুষের কাছে । তাঁর কলম আবেদন করবে আবহমানকাল, পৃথিবীর প্রথম প্রাণ উদ্ভিদ যেন রক্ষা পায় ।
ছবি গ্যালারি
________
মতামতঃ
_________
“পরিবেশ আন্দোলন এই শতাব্দীর আন্দোলন । পূর্বের শতাব্দীর রাজনৈতিক চেতনা দিয়ে পরিবেশ আন্দোলন করা সম্ভব না , তাই আমাদের চাই নতুন দর্শন , নতুন রাজনৈতিক ও সামাজিক চেতনা । সবুজ কবি বিভাস রায়চৌধুরী পরিবেশপন্থী নতুন সেই দর্শনের পিতা । নতুন সেই দর্শনের প্রথম শব্দ ও শেষ শব্দ ব্যথা । সমস্ত জগত এক পরিবারের সদস্য । আমরা একে অপরের পরিপূরক । পরিবারের সদস্যদের জন্য একে অপরের বলিদানের মাধ্যমেই সময় এগিয়ে চলে । গাছ নিজের জীবনকে উৎসর্গ করবে হরিণের জন্য , হরিণ জীবন দেবে বাঘের জন্য , বাঘ জীবন দেবে কাক শকুনের জন্য আর কাক শকুন জীবন দেবে নতুন গাছের জন্য । পরিবারের সদস্যদের একে অপরের জীবন রক্ষার জন্য জীবন দান যখন সৃষ্টির নিয়ম , তখন ব্যথা ছাড়া আর কি কিছু সত্যি হতে পারে ! সবুজ কবি বিভাস রায়চৌধুরী তার লেখনী , তার কবিতা , তার কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে এই সত্যিটাকে বারবার বলার চেষ্টা করেছেন – করে চলেছেন ।
“তোমরা হাঁটছ কেন?” , “আমরা গাছের ব্যথায় হাঁটছি ।“ যশোর রোডের গাছের জন্য পদযাত্রার সময় যখন তিনি এই উত্তরটা দিয়েছিলেন – ঠিক তখনই পৃথিবীর প্রথম পরিবেশপন্থী দর্শন জন্ম নেয় । তাই সবুজ কবি বিভাস রায়চৌধুরীকে পরিবেশ আন্দোলনের দর্শনের স্রষ্টা বলাই উচিত । আমাদের পরিবেশ আন্দোলনের অনুপ্রেরণা তিনিই – তাঁর জন্যই নিজেকে পরিবেশকর্মী বলতে গর্ব হয় ।“
– পরিবেশ কর্মী রাহুলদেব বিশ্বাস
লেখক
সৌভিক রায়
ভারতীয় উপ মহাদেশের পরিবেশ আন্দোলনের গবেষক ও লেখক
পরিবেশ আন্দোলন নিয়ে আপনার আরো তথ্য দেওয়ার থাকলে আমাদের জানান । Mail – poribesnews@gmail.com
পরিবেশ আন্দোলন গবেষণা পরিষদ