বোটস্বানায় (Botswana) ঘনীভূত হাতির রহস্য মৃত্যু :
বিশ্বব্যাপী করোনার দাপুটে আবহে কোনো কিছুই বোধ করি ভালো হচ্ছে না । সম্প্রতি বোটস্বানা সরকার সাংবাদিক সম্মেলন করে এক চাঞ্চল্যকর সংবাদ জানিয়েছেন সমগ্র বিশ্বকে, এই সংবাদে স্তম্ভিত সকলেই । একটি নয় ! দুটি নয় ! প্রায় 400টি হাতির মৃত্যু নিয়ে ক্রমশই ঘনীভূত হচ্ছে রহস্য । যদিও সরকারি মতে, সংখ্যাটা 281 !
বোটস্বানা সুদূর আফ্রিকার একটি দেশ,যেখানে প্রায় ১৩০,০০০ সাভানা হাতির বসবাস,পৃথিবীর মোট হাতির প্রায় এক তৃতীয়াংশই এখানে অবস্থিত । ২০১৩ সালের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী এই দেশে হাতির সংখ্যা ছিলো ১৫৬,০০০-এর কিছু বেশি ! ফলত একে ল্যান্ড অফ এলিফ্যান্ট ( Land of Elephant) নিঃসন্দেহে বলাই যায় । দেশটি একটি স্থল বেষ্টিত দেশ যার এক দিকে রয়েছে কালাহারি মরুভূমি এবং অন্য দিকে ওকাভাঙ্গো ডেল্টা,এই ডেল্টা অঞ্চলই হাতিদের প্রাকৃতিক বিচরণ ক্ষেত্র । গত মার্চ থেকে এই এলাকায় প্রায় 300টি হাতির মৃত্যু হয়েছে । স্থানীয় অধিবাসীদের কথা অনুযায়ী,প্রায় গত মে মাসে প্রায় ১৬৯ টি হাতির আশ্চর্যজনক ভাবে মৃত্যু হয় এবং দুই মাসের মধ্যে সংখ্যাটা ৩৫০ তে পৌঁছায় । যা ভাবিয়ে তুলেছে সকলকে, জীব বৈচিত্রের জন্য এ এক ভয়ানক ত্রাস ! এবং অশনি সংকেতও বটে ! এলিফ্যান্ট উইথআউট বর্ডার (EWB) -এর মতে সংখ্যাটা ৩৫৬ এবং তারাও এর কারণ অনুসন্ধান করছেন । EWB একটি সংস্থা যারা হাতি নিয়ে বিশ্বব্যাপী কাজ করে থাকেন ।
বোটস্বানা সরকার ও উক্ত বিষয় সংশ্লিষ্ট দফতরের অধিকর্তার জানিয়েছেন, অ্যানথ্রাক্স বা পোচিং অর্থাৎ চোরা শিকার মৃত্যুর কারণ নয় । মৃত দেহ পরীক্ষা করে অ্যানথ্রাক্স এর কোনো লক্ষণ পাওয়া যায় নি এবং যেহেতু মৃত হাতির দাঁত গুলো অক্ষত আছে ; তাই নিছক আইভোরির জন্য চোরা শিকারের দাবি নস্যাৎ করেছেন বোটস্বানা সরকার ।



অধিকাংশ ক্ষেত্রে, হাতির মৃতদেহ গুলো কোনো জলাশয় সংলগ্ন অঞ্চলে পাওয়া যাচ্ছে এবং নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে জলাশয়ের কাছেই পড়ে রয়েছে দেহ গুলো যা থেকে অনুমান করা যাচ্ছে যে,জল পান করেই মৃত্যু হয়েছে হাতি গুলির । সরকার তরফে জানানো হয়েছে আমেরিকা,কানাডা, ব্রিটেন এবং আফ্রিকার বিভিন্ন ল্যাবে পরীক্ষা চলছে । তাদের দাবি প্রাকৃতিক কোনো বিষক্রিয়ায় হাতিদের মৃত্যু হয়েছে । যার কারণ ওই বদ্ধ জলাশয় তে থাকা অণুজীব ,ব্যাক্টেরিয়া । বিভিন্ন প্রাণী দেহে বিভিন্ন প্রকার টক্সিন অর্থাৎ বিষ উৎপন্ন করতে পারে যা উক্ত প্রাণীর জন্য ক্ষতিকারক না হলেও অন্য প্রাণীদের জন্য বিপদ জনক হয় l বদ্ধ জলে থাকা সেই সব অণুজীবের দেহে উৎপন্ন বিষ সরাসরি প্রবেশ করেছে হাতির দেহে । সংক্রমণের একাধিক লক্ষণও রয়েছে মৃত দেহে l যদিও এখনও নিশ্চিত করে কিছুই বলা হয়নি ।



এছাড়াও কিছু সম্ভাব্য কারণ রয়েছে,সেগুলি হলো :
(১) স্টারভেশন ও ডিহাইড্রেশন অর্থাৎ পর্যাপ্ত খাবার এবং জলের অভাব হাতি মৃত্যুর অন্যতম কারণ । ওই অঞ্চলে পূর্ববর্তী বছর গুলিতে খরা হয়েছে ।
(২) জলে উপস্থিত সায়ানোব্যাক্টেরিয়া মূলত নীলাভ সবুজ শৈবাল খুবই ক্ষতিকারক, হাতি সাধারণতঃ জলাশয়ের মধ্যবর্তী অঞ্চল থেকে জলপান করে । ফলে সায়ানোব্যাটেরিয়ার দেহে উৎপন্ন টক্সিন জলের সাথেই প্রবেশ করেছে হাতির দেহে ।
(৩) অ্যানথ্রাক্স -এর কারণে হাতির বিপুল সংখ্যায় মৃত্যু হয় কিন্তু এক্ষেত্রে কোনো নির্ভর যোগ্য প্রমান মেলে নি । এটি একটি অণুজীব ঘটিত রোগ যার কিছু নিউরোলজিক্যাল লক্ষণ রয়েছে, যেমনঃ আক্রান্ত হাতি একটি নিৰ্দিষ্ট জায়গায় গোল করে ঘুরতে থাকে । সস্থানীয় কিছু প্রত্যক্ষদর্শী এই ঘটনা দেখেছেন বলে জানিয়েছেন । যার ফলে অ্যানথ্রাক্সকেও সম্ভাব্য কারণ হিসেবে কেউ কেউ দেখছেন ।
(৪) এক দল পরিবেশকর্মীদের ধারণা হাতি লোকালয়ে এসে ফসল নষ্ট করে,তাই স্থানীয় কৃষকেরা হয়তো হাতিদের দমন করার জন্য খাবারের সাথে বিষ দিয়েছেন ।
(৫) এই রহস্য মৃত্যুর কারন হিসেবে এনসেফালোমায়কারডাইটিস ভাইরাসকেও দেখা হচ্ছে কারণ এই সংক্রমণেও নিউরোলোজিক্যাল রোগ লক্ষণ প্রকাশ পায় । উক্ত ভাাইরাস রোডেন্টশিয়া গোত্রীয় স্তন্যপায়ীদের দেহে দেখা যায় । রোডেন্টসদের মল থেকে ভাইরাস পরিবেশে মুক্ত হয় এবং ঘাসের মধ্যে মল ত্যাগ করায় কন্টামিনেটেড ঘাসগুলো যখন হাতি খায়,তখনই হাতিরাও সংক্রমিত হয়ে পড়ে এবং পরে হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে মারা যায় ।
(৬) এছাড়াও বিভিন্ন প্রকার অণুজীব রয়েছে,যারা পূর্বে হয়তো হাতির প্রজাতির পক্ষে বিপদজনক ছিলো না কিন্তু অভিযোজিত হয়ে সংক্রমিত করছে । উদাহরণ স্বরূপ বিভিন্ন সার্স ভাইরাস ,করোনা ভাইরাসের কথা চলে আসে । পূর্বে এই মাইক্রোবসের হঠাৎ আক্রমণে বহু প্রজাতির ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার একাধিক দৃষ্টান্ত রয়েছে ।



EWB আরো জানাচ্ছে যে, প্রায় তিন মাস ধরে ঘটেচলেছে এই ঘটনা ! বয়স এবং লিঙ্গ নির্বিশেষে হাতিদের মৃত্যু অব্যাহত । বেশ কিছু জীবিত হাতি দেখা যাচ্ছে, যাদের দেহ রুগ্ন ও দুর্বল হয়ে পড়েছে । হাঁটার সমস্যা দেখা যাচ্ছে । বিশেষত পশ্চাৎ পদে থাকছে সমস্যা । নির্দিষ্ট করে কিছুই বলা যাচ্ছে না । তবে জিম্বাবোয়ে, ব্রিটেন ও আমেরিকার অত্যাধুনিক গবেষণাগারে বিজ্ঞানীরা অনুসন্ধান চালাচ্ছেন ।
সর্বোপরি হাতি মরছে না, মরছে আমাদের পৃথিবী।
সৌভিক রায়