ক্ষনিক দেখা । এক প্রখর গ্রীষ্মে । আমাদের গ্রামের ঘন সবুজ পাতায় ছাদ ঢাকা আমবাগানের নীচে । রৌদ্র-ছায়া মাখা শুখনো পাতার মেঝেতে । এক রাজা। এক রানী। টকটকে কমলা রঙিন তাদের গায়ের রঙ। রঙিন তাদের দাম্পত্যও। আমাদের মতোই। মানে মানুষদের মতোই। অবাক হলেন? ঘুলিয়ে গেলো? দাড়ান দাড়ান। বুঝিয়ে বলি।
আমার গল্পের রাজা-রানী আদপে দুটি পাখি। তাদের ইংরেজি নাম Orange headed thrush। বিজ্ঞানসম্মত নাম Zoothera Citrina। আমরা বাংলায় ‘লালমাথা দামা’ বলে থাকি। Orange headed thrush-এর এই উপজাতিটিকে (Citrina) উত্তর-পূর্ব ভারত জুড়ে ও হিমালয়ের কোল ঘেঁষে দেখা যায়। আরেকটি উপজাতি আছে। নাম Cyanotus। দেখতে একটু আলাদা। চোখের দুপাশে দুটি সাদা দাগ বর্তমান। দেখতে পাওয়া যায় সারা দক্ষিণ ভারত জুড়ে।
খাঁচার পাখি হিসেবে আমাদের দেশে সেরকম জনপ্রিয় না হলেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে Orange headed thrush-এর তুমুল চাহিদা। সেই চাহিদা মেটাতে জাভা এবং ইন্দোনেশিয়াতে Orange headed thrush-এর বাচ্চার বাণিজ্যিক উৎপাদন (harvesting) চলে।
অসাধারন সুন্দর গান গাইতে পারে Orange headed thrush। সেলিম আলি তার বই Handbook of the Birds of India and Pakistan-এর নবম খন্ডে ওদের গান গাওয়া নিয়ে লিখেছেন- “A typical Thrush song, loud, sweet and variable with some very high pitched notes, reminiscent of the Blackbird’s; contains many successive repetition of strophes (as a European Song Thrush, Turdus philomelos) and faithful imitations of other birds’ songs and call. Uttered chiefly in the morning and evening while sitting motionless, wings drooping at the sides and tail held low; usually given from low trees or down in dense cover.” সেই গান গাওয়ার ক্ষমতা তাদের খাঁচার পাখি হিসেবে আরও চাহিদাপূর্ণ করেছে।
তবে আমি তাদের তারস্বরে গান গাইতে দেখিনি। তাদের দাম্পত্যের যেটুকু সময়ের আমি সাক্ষী ছিলাম তা খুবই অল্প। সাকুল্যে তিনদিন। প্রথম দুটোদিন পরপর। তার দিনসাতেক বাদে একদিন। এমনিতে Orange headed thrush বেশ লাজুক। গোদাসাই ক্যামেরা আর মরিয়া ক্যামেরাম্যানের সামনে ধাতস্থ হতে বেশ সময় নিয়েছিলো তারা। তারপর আর অসুবিধা হয়নি!!
পুরুষ এবং স্ত্রীটিকে প্রায় একই রকম দেখতে। একটাই ফারাক। পুরুষটির পিঠের রঙ ধূসর আর স্ত্রীটির পিঠের রঙ বাদামি মিশ্রিত ধূসর।




পর্যবেক্ষনের প্রথম দিন
সাকুল্যে একঘন্টার পর্যবেক্ষন। তারই মধ্যে রাজা রানীকে তিন থেকে চার বার ঠোঁট ভর্তি কেঁচো খাওয়ালো। রানী, মানে স্ত্রী-পাখিটিকে বেশি নড়াচড়া করতে দেখিনি। বেশিরভাগ সময় নিজের পালক ঠোঁট দিয়ে পরিষ্কার করে যাচ্ছে। পাখনা দুটি দেহের দুপাশে সবসময় আলগা ভাবে পড়ে আছে।
আর পুরুষ-পাখিটি শুখনো পাতা সরিয়ে কেঁচো খুঁজে নিয়ে এসে মহানন্দে স্ত্রী-টির মুখে দিয়ে দিচ্ছে। খাওয়ার পর বারবার স্ত্রী-টি রৌদ্র-ছায়া মাখা শুখনো পাতার মেঝেতে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় যেখানে সূর্যের আলো এসে পড়েছে সেখানে ডানা দুপাশে ছড়িয়ে বসে পড়ছে। লক্ষ্য করে দেখলাম পুরুষটি একবার মুখে বেশকিছু বাসা তৈরির সরঞ্জাম নিয়ে শুকনো পাতার ওপর বসে থাকা স্ত্রীটির চারপাশ দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরে গেলো।



সেলিম আলি তার বই Birds of Indian Sub-continent-এ লিখেছেন শুধু পুরুষ-পাখিটির Courtship প্রদর্শন ও Courtship গান গাওয়ার কথা। এহেন খাইয়ে দেওয়ার কথা তিনি লেখেননি। স্ত্রী-টিকে ঠোঁট ফাঁক করে পুরুষ-টির কাছে খাবার প্রার্থনাও করতে দেখলাম। ঠিক যেভাবে বাচ্চা তার বাবার কাছে হাঁ করে খাবার চায়।



পর্যবেক্ষনের দ্বিতীয় দিন
সেই একই দৃশ্য। পুরুষ-টি নির্দিষ্ট সময়ান্তরে খাইয়ে চলেছে স্ত্রী-টিকে। তবে ডানা ছড়িয়ে বসে থাকার কাজটি স্ত্রী-পাখিটা আর করছিলো না।



পর্যবেক্ষনের তৃতীয় দিন
একটা অদ্ভুত স্বভাব লক্ষ্য করলাম। পুরুষ-টি আগের মতই স্ত্রী-টিকে খাইয়ে চলেছে।
হঠাৎ স্ত্রী-টি ঠোঁটে করে একটা শুখনো ঘাস তুললো।
পুরুষ-টি কাছেই ছিলো। সে খুব দ্রুত পাল্টা কিছু ঠোঁটে করে খড়-কুটো জোগাড় করে স্ত্রী-টির কাছে এলো। তারপর গাছের ডালে বসে পরস্পরের ঠোঁট থেকে সেই খড়-কুটো বিনিময় করে নিলো।
পক্ষীবিদ্যার ভাষায় দামা পাখির nesting material sharing
এই তিনদিনে যতবার খাওয়াতে দেখেছি, প্রত্যেকবার কেঁচো ছিলো খাদ্য বস্তু। শুধু একবার ছিলো জিলিপি গাছের ফল এবং সেই ফল স্ত্রী-টিকে খাওয়াতে পুরুষটির সেরকম উৎসাহ ছিলো না, যদিও স্ত্রীটি প্রতিবারের মত সেবারও খাবার চাইতে দ্বিধা করেনি।
অনুমানভিত্তিক সিদ্ধান্ত
১. পৃথিবীর বহু পুরুষ পাখি তাদের প্রজনন মরসুমে সঙ্গিনী নির্বাচনের সময় থেকে ডিমে তা দেওয়ার সময় পর্যন্ত সঙ্গিনীকে খাইয়ে যায়। পাখিদের এই স্বভাবকে পক্ষীবিদ্যার ভাষায় Courtship feeding বলে আর যে সব খাদ্যবস্তু দেওয়া হয় (present) তাকে Nuptial gift বলে। আমেরিকান রবিনের ক্ষেত্রে আবার উল্টোটাও ঘটে। স্ত্রী-পাখি পুরুষটিকে খাওয়ায়।
২. স্ত্রী-পাখিটির ওইরকম ডানা ছড়িয়ে বসে পড়ার ঘটনাটি সম্ভবত স্ত্রী-পাখিটির সম্মতি জানানোর লক্ষণ। যদিও এই বিষয়ে আরও পর্যবেক্ষন ও গবেষণার অবকাশ আছে।
৩. বেশ কিছু কারনে পুরুষ-টি স্ত্রী-টিকে প্রজননের সময় খাওয়ায়।
প্রথমত সঙ্গী নির্বাচনে সাহায্য–পাখিদের প্রজননের সময় সঙ্গী নির্বাচনে courtship feeding–এর সরাসরি প্রভাব আছে। ২০০৩ সালে বিজ্ঞানী Helfensteinফ্রান্সের উপকূলে Black-legged Kittiwake- এর ওপর দীর্ঘ দিন গবেষণা করে দেখিয়েছেন, আগের প্রজনন মরসুমেযদি পুরুষটি courtship feeding-এর দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করে থাকে তবে পরের বছর সেই পুরুষটিকেই স্ত্রী-পাখিটি প্রজননসঙ্গী হিসেবে বেছে নেয়।
দ্বিতীয়ত সুদৃঢ় দাম্পত্যের প্রতীক – এই কাজটি তাদের দাম্পত্যের বন্ধনকে সুদৃঢ় করে। সঠিক পরিমান ও গুনমানের খাবার (nuptial gift) স্ত্রীটিকে বিচ্ছেদের (Divorce) ভাবনা থেকে বিরত করে। স্ত্রীটি এইভেবে নিশ্চিত হয় যে তার সঙ্গী ভবিষ্যতে তাদের বাচ্চাদের একই ভাবে খাদ্যের যোগান দিতে পারবে। বিজ্ঞানী lack ১৯৪০ সালে অ্যারিজোনাতে Roadrunner-এর ওপর গবেষণা করে দেখিয়েছেন স্ত্রীটি ঠিক বাচ্চাদের মত পুরুষটির কাছে খাবারের বায়না (begging) করে।
তৃতীয়ত প্রত্যক্ষ উপকার (Direct benefit) – যদিও এই সময় স্ত্রী-পাখিটির সমস্ত খাদ্যের যোগান পুরুষ-পাখিটি দেয় কিনা তা আমার পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি। তবুও এটা বলা যেতেই পারে যে স্ত্রী-টির খাওয়ারের যোগানের দায়িত্ব অনেকটাই পুরুষ-টি নেয়। প্রজননের সময় স্ত্রী-কে শরীরে ডিম তৈরি, ডিম পাড়া, ডিমে তা দেওয়ার জন্য তাপমাত্রা তৈরি ইত্যাদি কাজে প্রচুর শক্তি খরচ করতে হয়। পেটে ডিম থাকা অবস্থায় স্ত্রীটির শারীরিক সক্ষমতা হ্রাস পায়।
তাছাড়া ডিমে তা দেওয়ার সময় স্ত্রীটিকে বাসাতে অনেক সময় ব্যয় করতে হয়। পুরুষ-টি এই সময়গুলোতেস্ত্রী-কে খাদ্যের যোগান দিয়ে সাহায্য করে। এতে পুরুষ-টির কি লাভ হয়? পুরুষ-টির বেশ কয়েকটি লাভ। এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে খাদ্যের যোগান ঠিক-ঠাক থাকলে ডিমের সংখ্যা (Clutch size) এবং গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে।
ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা বের হতে কম সময় লাগবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে সেলিম আলি লিখেছেন যে Orange headed thrush-র cyanotus উপজাতি স্ত্রী-রা ডিমে তা দিতে অপেক্ষাকৃত বেশি সময় দেয় পুরুষদের তুলনায়।
৪. তৃতীয় দিনের সেই অদ্ভুত আচরনের সঠিক ব্যখ্যা আমার কাছেও নেই। অনুমানের ভিত্তিতে বলা যেতে পারে হয়তো স্ত্রী-পাখিটি ঠোঁটে করে একটা শুখনো ঘাস তুলে পুরুষ-টিকে বলতে চাইলো এবার বাসা বাঁধার সময় এসে গেছে।
শুখনো ঘাস তাদের বাসা বাঁধার কাজে ব্যবহৃত হয়। তবে অনেক পাখির ক্ষেত্রে সফল দাম্পত্যের অংশ হিসেবে বাসা তৈরির উপকরণ ভাগ করে নেওয়ার রীতি আছে। গ্রে হেরন-দের ক্ষেত্রে এই স্বভাব প্রায়ই দেখা যায়। Adelie Penguin-দের ক্ষেত্রে দেখা গেছে courtship feeding-এর সময় ছোটো নুড়ি (pebbles) nuptial gift হিসেবে দেওয়া হয় । যা তাদের বাসার কুশন তৈরিতে কাজে লাগে। যদিও Orange headed thrush-র ক্ষেত্রে এই অভিজ্ঞতা আমার প্রথম।
শেষে বলি, ওদের Mating আমি ওই তিন দিনে দেখিনি। আমি যেখানে ওদের এই সুমধুর দাম্পত্যের সাক্ষাত পেয়েছিলাম সেখানে ওরা বাসাও বাঁধেনি। তবে মুখে করে বাসা তৈরির জন্য শুখনো ঘাস অন্যত্র নিয়ে যেতে দেখেছি । পুরুষ-টিকে একাধিকবার শুখনো ঘাস অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছিল।
ওদের সেই দাম্পত্য সফল হয়েছে বলে স্থানীয়দের কাছ থেকে খবর পেয়েছি। ওই আমবাগানেই বাচ্চাদের নিয়ে মা-বাবা আসতো খাওয়ানোর জন্য। আজও সেই আমবাগানে গেলে মনে হয় কমলা রঙের রাজা-রানী লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরে বেরাচ্ছে রৌদ্র-ছায়া মাখা শুখনো পাতার মেঝেতে।
লেখা ও ছবি – সম্রাট সরকার
ইমেল – samratswagata11@gmail.com