ভারতে পরিবেশ আন্দোলনে মহিলা
ভারতে পরিবেশ আন্দোলনের এক সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, সেই বিশনোইদের সময় থেকে চিপকো প্রতিটি পরিবেশ তথা গাছ বাঁচাও আন্দোলনে আমরা নারীদের পেয়েছি আন্দোলনের পুরোভাগের নেতৃত্বে এবং লড়াই -এর ময়দানেও তাঁরা স্বমহিমায় শ্বাসত l
এই আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস এবং এটাই আমাদের ঐতিহ্য ! সেই রকমই এক বীরঙ্গনার বীরগাঁথা গল্প বলবো আজ, অরণ্য রাজ্যের অরণ্য বাঁচাও আন্দোলনের বীরসেনানী তিনি !
ছেলেবেলায় পড়া টারজানের কথা মনে পড়ে? সেই যে জঙ্গলে বেড়ে ওঠা নাম না জানা একা এক শিশু? অরণ্যই তার জীবনে, পশু পাখি আর জঙ্গলকে ভালোবেসে চলা,উভয়ের উভয় কে রক্ষা করা ! কারণ, জঙ্গলই ছিল তার জীবনদাত্রী, তার মা,তার বন্ধু তার আশ্রয় সব কিছু । অনিন্দ্য সুন্দর এক উপাখ্যান !
অরণ্য রাজ্যের যমুনা টুডু
এই বীরঙ্গনাও টারজানের মতোই অরণ্যপ্রেমী এবং অরণ্যের সুরক্ষায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন কিন্তু টারজানের মতো তিনি কোনও বিদেশী গল্প-কাহিনীর চরিত্র নন। বরং এই ভারতেই সাক্ষাৎ মেলে তাঁর। তিনি অরণ্য রাজ্যের যমুনা টুডু। অরণ্যের রক্ষার্থী স্থানীয়দের ভাষায় ‘দ্য লেডি টারজান’।
ঝাড়খণ্ডের পূর্ব সিংভূমের চাকুলিয়ার বাসিন্দা যমুনা টুডু।
বিয়ের আগে তাঁর ঠিকানা ছিল ময়ূরভঞ্জ। সেখানেই রুক্ষ জমিতে গাছের চারা রোপন করে তাদের যত্নসহকরে বড়ো করতেন যমুনা দেবীর বাবা।
ফলতই বাবাকে দেখে শৈশব থেকেই গাছের প্রতি এক নিঃস্বার্থ ভালোবাসা জন্মায় যমুনাদেবীর। বিয়ের পর ঝাড়খণ্ডে আসেন তিনি।
তারপর থেকেই নিঃসন্তান এই আদিবাসী মহিলার কাছে জঙ্গলই যেন হয়ে ওঠে তাঁর আত্মজ ! আর সেই ‘সন্তান’-এর রক্ষাতেই বারবার এগিয়ে এসেছেন তিনি।
অরণ্য রক্ষায় লড়াই
প্রায় দেড় দশক ধরে তিনি অরণ্য রক্ষায় ব্রতী হয়েছেন । প্রায় একাহাতেই কাঠ মাফিয়া এবং গাছ চোরাচালানকারীদের প্রতিহত করেছেন । সম্বল বলতে ইচ্ছাশক্তি , হার না মানা মনোভাব আর অসীম সাহস ; এই জিনিসের ওপর ভর করেই আজ তিনি ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলের রাণী, জঙ্গলের রক্ষার্থী ।
জন্ম
১৯ ডিসেম্বর ১৯৮০ সালে ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার রায়রংপুরে এক আদিবাসী কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন যমুনাদেবী।
পড়াশোনা
দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন ।
বিবাহ
১৯৯৮ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে রায়রংপুর থেকে ১০০ কিমি দূরে অবস্থিত ঝাড়খন্ড-এর পূর্বে সিংভূম জেলার মুতুরাখাম গ্রামের মান সিং টুডুর সাথে বিবাহ হয় যমুনা দেবীর ।
মান সিং টুডু পেশায় একজন ক্ষুদ্র মানের কনট্রাকটর, তিনি গ্রামে গ্রামে বাড়ি তৈরি করেন।
বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে এসে আর পাঁচজন সাধারণ গৃহবধূর মতো থাকেননি । তিনি শুরু করেন অরণ্য বাঁচানোর এক অসাধারণ সংগ্রাম ।
গাছ বাঁচানোর ভীষণ সংগ্রাম
চাকুলিয়ার বিয়ে হয়ে আসার পর যমুনা দেবীর নজরে আসে আশেপাশের শাল বন কেটে গাছ পাচারের ঘটনা । এরপরই অভিযানে নেমে পড়লেন তিনি । শুরু হল লড়াই পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন। প্রতিনিয়ত জঙ্গল বাঁচানোর ভীষণ সংগ্রাম ।
কোথাও কোনও গাছ কাটার খবর পেলেই ছুটতেন তাঁরা। হাতে নাতে ধরতেন অপরাধীদের। তবে এই কাজ মোটেও সহজ ছিল না।
স্থানীয় মহিলাসহ ‘বন সুরক্ষা সমিতি’
গাছ চোরাচালানকারীদের রুখতে গিয়ে বহুবার আঘাতও পেয়েছেন যমুনা দেবী । ১৯৯৮ সালে যমুনা টুডু নিজে এবং সাথে আরো পাঁচ জন স্থানীয় মহিলাসহ ‘বন সুরক্ষা সমিতি’ গড়ে তােলেন l
কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে বন বাঁচানাের এই উদ্যোগে তীব্র বিরোধিতা আসে সাধারণ
গ্রামবাসীদের তরফ থেকেই, কারন গ্রামবাসীদের কাছে বন হল জ্বালানি কাঠের প্রধান উৎস।
স্থানীয় মানুষদের সচেতনতা করা
যমুনাদেবীরা স্থানীয় মানুষদের সচেতনতা তৈরী করতে থাকেন । জ্বালানি হিসেবে ছোটো ডালপালা ব্যবহার করতে হবে, এবং যতটা সম্ভব বড়ো গাছ না ব্যবহার করাই উচিত। তাতেই রক্ষা পাবে অরণ্য । সেইসময় ঝাড়খন্ড রাজ্যের বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলে জুড়ে বন মাফিয়াদের রাজত্ব চলত।
পরিবেশ আন্দোলনের জন্য হামলার শিকার
বেআইনিভাবে জঙ্গল কেটে মুনাফা অর্জন ছিল উপার্জনের একটি সহজ মাধ্যম । বন-মাফিয়া এবং কাঠ চোরাচালানকারীদের থেকে হুমকি,বাধা পেয়েও থেমে থাকেননি যমুনাদেবী।
টারজান লেডি যমুনাদেবী বন্দুকবাজ বন-মাফিয়াদের বিরুদ্ধে লাঠি, তীর-ধনুক, বর্শা হাতেই স্থানীয় মহিলারা তাঁর নেতৃত্বে বনরক্ষার লড়াই শুরু করেন।

আস্তে আস্তে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। স্থানীয় গ্রামবাসীদের মধ্যে অরণ্য সংরক্ষণের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। বন-মাফিয়াদের কাছ থেকে যমুনাদেবী খুনের হুমকিও পেয়েছেন।
২০০৪ সালে চাকুলিয়া শহরে তাঁর বাড়িতে হামলা হয়। ২০০৮ সালে যমুনাদেবী ও তাঁর স্বামীর ওপর প্রাণঘাতী হামলা হয়। অল্পের জন্য প্রাণে তাঁরা রক্ষা পান ।
তবুও এই সাহসী নারী পরিবেশ বাঁচানোর লড়াই ছাড়েননি । মুতুরখাম গ্রামসংলগ্ন প্রায় ৮০ একর বনভূমি বাঁচাতে সক্ষম হয়েছে এই বীরাঙ্গনার নির্ভীক লড়াই । এখন বর্তমানে “বন সুরক্ষা সমিতির”, ৩০০ টি দল রয়েছে এবং প্রত্যেক দলে ৩০ জন করে সদস্য রয়েছেন ।
তাঁরা যমুনাদেবীর নেতৃত্বে আজও বনভূমি বাঁচাতে নিরলস কাজ করে চলেছেন। এখন ঝাড়খন্ড পুলিশ ও বন বিভাগ তাঁদের নিয়ে যৌথভাবে বনরক্ষার কাজ পরিচালনা করেন।
সরকারের সহায়তা
ঝাড়খন্ড সরকার বর্তমানে যমুনাদেবীর গ্রামটিকে দত্তক নিয়েছেন। শিক্ষা ও জল পরিষেবার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা হয়েছে।
যমুনাদেবীদের নিরলস লড়াইয়ে সুফল হিসেবে বলা যায় । বর্তমানে তাঁর গ্রামে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হলে ১৮ টি গাছ এবং একটি মেয়ের বিয়ে হলে ১০ টি গাছ লাগানোর নিয়ম চালু রয়েছে।
যমুনাদেবী গাছকে ভাই-এর চোখে দেখেন। প্রতিবছর রাখীবন্ধনের দিন তিনি ও তাঁর বন সুরক্ষা সমিতির সদস্যরা গাছে রাখী বাঁধেন।
বিভিন্ন পুরষ্কার প্রাপ্তি

অরণ্য সংরক্ষণে সাফল্যে এবং পরিবেশ রক্ষায় অবদানের জন্যে, স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি একাধিক পুরষ্কার পেয়েছেন ।
২০১৪ সালে স্ত্রী শক্তি পুরস্কার, গডফ্রে ফিলিপস সাহসিকতা পুরষ্কার ; ২০১৭ সালে Women Transforming ইত্যাদি।
২০১৯ সালে ভারত সরকার তাঁর অরণ্য সংরক্ষণের নিরলস উদ্যোগকে সম্মান জানিয়ে পদ্মশ্রী পুরস্কার প্রদান করে।