এইটুকু এক মানবদেহ, অথচ কত অপার রহস্যের ভাণ্ডার, ভাবা যায়! যুগের পর যুগ ধরে চলে আসা মানব শারীরবিদ্যার চর্চা, শব ব্যবচ্ছেদ এবং তাদেরকে নিয়ে এতকাল ধরে নিবিড় পর্যবেক্ষণ, এত গবেষণার পর সত্যিই মনে হয়েছিল হিউম্যান এনাটমি মানে মানব অঙ্গসংস্থানের সমস্ত তথ্যই যেন আমাদের জ্ঞানের ভাণ্ডারে জমা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, মানবদেহ যে আরো কতভাবে আমাদেরকে আশ্চর্যজনক করে দিতে পারে, আমাদেরকে ভুল প্রমাণিত করতে পারে- তা যেন এবার একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ করা হল।
নেদারল্যান্ডসের একদল গবেষক সম্প্রতি যা আবিষ্কার করেছেন, তা হল এমন একজোড়া অঙ্গ, যা এতদিন ধরে ‘চোখের সামনে’ দেখতে পেয়েও ‘অঙ্গ’ বলে শনাক্ত করতে পারেনি বিজ্ঞানীমহল, ফলস্বরূপ এর উপস্থিতি ছিল সকলের দৃষ্টির অগোচরে।
নাসাগহ্বর যে অঞ্চলে এসে ফ্যারিংক্সের সাথে মিলিত হয়, সেই অঞ্চলের এক গহ্বরে লুকায়িত অবস্থায় আছে আর একজোড়া লালাগ্রন্থি ! যদি এই গবেষণার সত্যতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়া যায়, তাহলে মেনে নিতেই হবে,মানবদেহে এধরনের শনাক্তকরণ বিগত প্রায় ৩০০ বছরে একবারও করা হয়নি!!! কাজেই এই আবিষ্কার শুধুমাত্র এই বছর বা দশকের জন্য নয়, কয়েক শতাব্দীর বিজ্ঞানশিক্ষা ও গবেষণার জগতে এক মাইলফলক হয়ে থাকবে।
আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রে এনাটমির যে কোনো বইয়ে তিন রকমের প্রধান। তিনজোড়া লালাগ্রন্থির কথাই পাওয়া যায়- দু’ কানের নীচে একজোড়া প্যারোটিড গ্রন্থি, চোয়ালের নীচে একজোড়া সাবম্যাণ্ডিবুলার গ্রন্থি আর জিভের তলায় একজোড়া সাবলিঙ্গুয়াল গ্রন্থি।
এছাড়াও ন্যাসোফ্যারিঞ্জিয়াল অঞ্চলে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লালাগ্রন্থি আছে। কিন্তু এই গবেষণা পথ উন্মুক্ত করে দিলো চতুর্থতম প্রধান একজোড়া লালাগ্রন্থির উপস্থিতির । নেদারল্যান্ডসের সার্জন তথা গবেষক Dr. Matthijs Valstar এর তো অন্তত তাই মত-
“Now, We think there is a fourth”.
তিনি নিজে নেদারল্যান্ডস ক্যান্সার ইন্সটিটিউটের গবেষক এবং একইসাথে এই গবেষণাপত্রটিও তাঁরই লেখা, যা ‘Radiotherapy and Oncology’ জার্নালে প্রকাশিত হয় গত মাসে (সেপ্টেম্বর, ২০২০)।
খুব আশ্চর্যজনক হলেও এটাই সত্যি যে এই অঙ্গের আবিষ্কারের উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো গবেষণা হয়নি। বরং প্রস্টেট ক্যান্সার নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে এই একজোড়া লালাগ্রন্থি আবিষ্কৃত হয় আকস্মিকভাবেই! বিজ্ঞানের অনেক আবিস্কারের মতো এটাও হঠাৎ কাকতালীয় ভাবে আবিষ্কার হয়েছে।
নেদারল্যান্ডসের সেই ক্যান্সার ইন্সটিটিউটে বিজ্ঞানীরা প্রস্টেট ক্যান্সার কোষ নিয়ে গবেষণা করছিলেন PSMA PET-CT প্রযুক্তির সাহায্যে। এই প্রযুক্তি আসলে CT scan ও Positron Emission Tomography এর মেলবন্ধন – যা লালা নিঃসরণকারী গ্রন্থির কলাগুলোকে চিহ্নিত করার জন্য আদর্শ।
এই পদ্ধতিতে একটি তেজস্ক্রিয় পদার্থকে ‘Tracer’ হিসেবে ব্যবহার করা হয় যা রোগীর দেহে প্রবেশ করিয়ে দিলে তা PSMA প্রোটিনের সাথে যুক্ত হয়।
এই প্রোটিনের পরিমাণ প্রোস্টেট ক্যান্সারের ফলে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু আকস্মিকভাবে, সবাইকে অবাক করে দিয়ে আবিষ্কৃত হল নতুন লালাগ্রন্থির উপস্থিতি, অপ্রত্যাশিতভাবে।
তবে বিজ্ঞানজগতে এধরনের আশ্চর্য তো একেবারে নতুন নয়,ফ্লেমিং-এর হাতে পেনিসিলিনের মতো জীবনদায়ক মহৌষধের আবিষ্কারও তো একপ্রকার আকস্মিক বলা যায়। নিঃসন্দেহে এধরনের আকস্মিকতা মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায় কয়েক দশক সম্মুখে, এক ধাক্কায়।
জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা অনুসারে গবেষকেরা অন্ততপক্ষে ১০০ জন রোগীর ওপর পরীক্ষা করেছেন এবং সকলের মধ্যেই এই নতুন আবিষ্কৃত লালাগ্রন্থির উপস্থিতি লক্ষ্য করেছেন।
নাকের পেছনে, ন্যাসোফ্যারিংক্স অঞ্চলের এই ছোট্ট অংশটাকে কোনো স্বতন্ত্র অঙ্গ বলে কল্পনাই করা যায়নি কোনোদিন। শুধু অনুমান করা হত, কতগুলো আণুবীক্ষণিক লালা নিঃসরণকারী কলা এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
নতুন আবিষ্কৃত লালাগ্রন্থি কি নাম রাখা হল ?
এতক্ষণ ধরে এত কথা বলা হল, কিন্তু এই আসল কথাটাই বলা হল না। গবেষকেরা বলছেন, যেহেতু কণ্ঠনালীর ঊর্ধ্বাংশে, টরাস টিউবারিয়াস (torus tubarius) নামক তরুণাস্থির ওপর এই গ্রন্থিজোড়া অবস্থিত, তাই এদের নামকরণ করা হল- টিউবেরিয়াল স্যালাইভারী গ্ল্যান্ডস (Tuberial salivary glands)।
নতুন আবিষ্কৃত এই টিউবেরিয়াল লালাগ্রন্থি গড়ে ১.৫ ইঞ্চি বা ৩.৯ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট। গবেষকদের মতে, এই গ্রন্থিদ্বয় সম্ভবত নাক এবং মুখের পেছনে কণ্ঠের উপরিভাগকে পিচ্ছিল করতে আর আর্দ্র রাখতে সাহায্য করে।
বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসকমহলের দৃষ্টিতে, এই আবিষ্কার চিকিৎসাশাস্ত্রে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিল। ভবিষ্যতে করোটির এই অঞ্চলে কোনো ধরনের গোলযোগ হলে ডাক্তারদেরকে নতুন আরও কোনো সম্ভাবনার কথা ভাবতে হতে পারে।
গবেষণা দলের আরেকজন সদস্য Dr. Vogel তো এই আবিষ্কারের ফলে জানিয়েই দিচ্ছেন তাঁদের পরবর্তী গবেষণার সম্ভাবনার কথা—পরবর্তীতে আমরা গবেষণা করতে চাই এমন পদ্ধতি নিয়ে যাতে এধরনের নতুন আবিষ্কৃত গ্রন্থিকে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না করে রোগীর দেহে চিকিৎসা চালানো যায়। এতে করে তাদের মধ্যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনুভূত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে।
(যেহেতু এটা খুব সাম্প্রতিক গবেষণালব্ধ ফল, তাই বিস্তারিত তথ্য বলতে এর চেয়ে বেশি বলার মতো উল্লেখযোগ্য কিছুই নেই।
গবেষণা পরবর্তীতে কোনদিকে মোড় নেয়, সে দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখার চেষ্টা থাকবে এবং কোনো নতুন তথ্য উদঘাটিত হলে, সংযোজন করে দেওয়ারও আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকবে।ধন্যবাদ )
0 (0) একজন পরিবেশকর্মী হিসাবে ভারতের তিনটি কৃষি বিলকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছি । এক – The Farmers Produce Trade and Commerce Bill, 2020 এই বিলের কতগুলি গুরুত্বপূর্ন পয়েন্ট নিয়ে বলি । ১। কৃষক তার ফসল এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে বিক্রি করতে পারবে । এটা নতুন কিছু না , […]